শাহরাস্তিতে করোনার হটস্পট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স!

এক সপ্তাহে নমুনার রেজাল্টে আক্রান্ত ৪০ ভাগ

ফয়েজ আহমেদ :
শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত এক সপ্তাহে করোনা সন্দেহে নমুনা দেয়া লোকজনের ৪০ ভাগ রোগীর রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। ফলাফল আসার পূর্বে কাউকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত নিশ্চিত না করার ফলে হাসপাতালের জরুরী বিভাগ, বহিঃবিভাগ, ল্যাবরুম ও বিভিন্ন চিকিৎসকের কক্ষে সন্দেহজনক করোনা রোগীর ঘুরাঘুরিতে ব্যপক হারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।

ইতোমধ্যে ওই হাসপাতালের ২জন মেডিকেল অফিসার একজন স্যাকমো ও ২জন স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৫জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। নমুনা দেয়ার পর রিপোর্ট আসতে ৩-৪ দিন দেরী হলেও ওই সময়ে আক্রান্ত চিকিৎসকরা তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় তাদের দ্বারা অন্যান্য রোগী ও হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীরা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন হাসপাতালের বাকী চিকিৎসকরা।

নমুনা দেয়ার জন্য নির্ধারিত ল্যাবকক্ষে সাধারণ রোগীদের অন্যান্য পরীক্ষা করা, পূর্ব পাশের কক্ষে শিশুদের টিকাদান ও একটু দক্ষিণে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অফিস এবং হাসপাতালের প্রশাসনিক কক্ষ থাকায় নমুনা দিতে আসা রোগীদের আনাগোনায় ব্যপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা যায় গত এক সপ্তাহে (১০ জুন হতে) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯২টি রিপোর্ট এসেছে। প্রদত্ত ফলাফলে ৪৪জন আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৩জন ডাক্তার একজন স্যাকমো, ২জন স্বাস্থ্যকর্মী, ৩জন পল্লী চিকিৎসক (১জন মৃত), ৩জন পুলিশ ও ৪জন জনপ্রতিনিধি (১জন মৃত) রয়েছেন। গত এক সপ্তাহে আসা রিপোর্টে শতকরা ৪০জন আক্রান্ত রয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে নমুনা দিয়ে রোগীরা ফার্মেসী হতে ওষুধ নিয়ে বাড়ি চলে যায়। ৩/৪ দিন ঘুরাফিরার পর জানতে পারে তার রিপোর্ট পজেটিভ। এই সময়ের মধ্যে সে অনেকের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখি, অথচ সন্ধিগ্ধ ব্যক্তি নমুনা দেয়ার পর পরই আইসোলশনে চলে যাওয়া উচিৎ।

আরেকজন মেডিকেল অফিসার জানান, রোগীরা তথ্য গোপন করায় চিকিৎসকরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। উপসর্গহীন রোগীরা ফ্লু কর্ণারে না গিয়ে বহিঃবিভাগে যাওয়ায় অন্যান্য রোগী ও চিকিৎসকরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। এছাড়া চিকিৎসকরা নমুনা দিয়ে ৩/৪ দিন রোগী দেখার পর যখন জানতে পারেন তারা নিজেরাও আক্রান্ত তখন ডিউটি হতে আইসোলশনে যান। অথচ এই ৩/৪ দিন তাদের কাছ হতে চিকিৎসা নেয়া রোগী ও হাসপাতালের সহকর্মীরা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি প্রকট।

অন্যদিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে তথ্য গোপন করায় সেখানে কর্মরতরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। গত ৮ জুন রাতে রাতে নমুনা দেয়ার তথ্য গোপন রেখে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে মারা যান টামটা উত্তর ইউনিয়নের দৈলবাড়ি গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আঃ মোমেন। ওই সময় তাকে চিকিৎসা দিতে সহায়তা করেন হাসপাতালের স্যাকমো মোঃ আবু সুফিয়ান। ১০ জুন মৃত ওই চিকিৎসকের নমুনা পজেটিভ আসে।

এর আগের রাতে ওই স্যাকমো মৃতঃ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সফি আহম্মেদ মিন্টুর চিকিৎসাসেবা দেন। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের জানান, তার নিজের আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়েছে এবং ১১ জুন তিনি নমুনা পরীক্ষার জন্য দেন। ১৩ জুন আসা রিপোর্টে তার করোনা পজেটিভ আসলেও রিপোর্ট আসার দিনেও তিনি কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবে রোগী হতে চিকিৎসক, চিকিৎসক হতে রোগী হয়ে একের পর এক সংক্রমিত হচ্ছে।

স্থানীয়রা করোনার হটস্পট হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১নম্বরে ধরলেও জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সদস্যরাও পিছিয়ে নেই। করোনা আক্রান্ত হয়ে টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম মানিক তার ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, ‘গতকাল আমার করোনা পজেটিভ আসছে। ইনসাআল্লাহ আমার মনোবল দৃঢ় আছে। তাছাড়া আপনাদের সকলের দোয়া আমার সাথে আছে। কিন্তু আমি ভাবছি গত কয়েক দিনে দায়িত্বের কারণে কয়েকশো লোকের সাথে মেলামেশা হয়েছে, অতি জরুরী কয়েকটা শালিশও করতে হয়েছে। তাদের নিয়ে চিন্তিত’।

আরেক জনপ্রতিনিধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মেহের দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সফি আহম্মেদ মিন্টুর মৃত্যুর আগে করোনা পজেটিভ রিপোর্ট না পাওয়ায় তাকে অন্তিম বিদায় জানাতে ফুল নিয়ে জানাজায় ছুটে গিয়েছিলেন বিভিন্ন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবন্দ। তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসার পর ওই এলাকার ভোলদিঘী বাজার লকডাউন দেয়া হয়েছে। জানাজায় উপস্থিতদের হোম কোয়ারেন্টেনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শাহরাস্তি থানায় কর্মরত পুলিশ অফিসার ও সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা সংকটে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা সহ লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টেন নিশ্চিত করছেন। বিশেষ ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস উপসর্গহীন হওয়ায় নমুনা পরীক্ষার জন্য দেয়ার পরও তাদের কর্মক্ষেত্রে তৎপর থাকতে দেখা যাচ্ছে। এতে থানার সকল পুলিশ ও জনসাধারণের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ প্রতীক সেন জানান, নমুনা দিয়ে কর্মস্থলে থাকা ব্যক্তিরা সেবাদান করায় ঝুঁকি বেড়ে গেছে। সিভিল সার্জনের পরামর্শ মোতাবেক এখন থেকে নমুনা দেয়া ব্যক্তিরা হোম কোয়ারেন্টেনে থাকার অঙ্গীকার দিতে হবে। অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ চিন্তা করে হাসপাতালের টিকাদান কক্ষটি অন্যত্র সরানো হয়েছে। করোনা নমুনা সংগ্রহের আলাদা টেবিল নির্ধারণ ও বিশেষ সতর্কতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শাহরাস্তি উপজেলায় এ পর্যন্ত ২৬৭ জনের রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্টে ৬২জন করোনায় আক্রান্ত রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৩জন মৃত ও ৪জন সুস্থ হয়েছেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন