অনৈতিহাসিক : একটি রাস্তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী

মুহম্মদ শফিকুর রহমান :

একাত্তরের গণহত্যা-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার সাথে সাথে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাঙ্গন থেকে দলে দলে ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য শহর ছেড়ে প্রথমে গ্রাম তারপর কেউ পূর্বাঞ্চল দিয়ে আগরতলা কেউ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে কলকাতা চলে যায় এবং যুদ্ধে যোগ দেয়। সাধারণ নারী-পুরুষরা জীবন বাঁচাতে যে যেদিকে পেরেছে বর্ডার ক্রস করে ভারতের গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

সেবার-তো একটা উপায় ছিল কোনরকমে বর্ডারটা ক্রস করতে পারলে মৃত্যু ভয় নেই। কিন্তু এবার আমরা কোথায় যাব? সবাই-তো আক্রান্ত। কোন জাগা কোন একটা দেশ নেই যেখানে মারণাস্ত্র করোনা ভাইরাস নেই। কেউ কাউকে দেখতে আসতেও পারছেনা। বিশ্বের সাড়ে ৭শ কোটি মানুষ সবাই আতংকিত, প্রাণঘাতী দানব মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে অবাক কান্ড হলো যে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহে চলে গেলেন, যে বিজ্ঞানীরা অবলম্বন ছাড়া আকাশে প্লেন-রকেট চালান, যে বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে কলেরা-ওলাউঠা-বসন্ত নির্মূল করে দিলেন, বিজ্ঞানের শক্তি দিয়ে অদৃশ্য শত্রুকে ঘায়েল করেছেন যে বিজ্ঞানীরা তারাও আজ আতংকে, কখন তিনি আক্রান্ত হবেন, ঘর থেকে কেউ বেরোচ্ছেননা। কি গজব নামল মানব জাতির ওপর সে কেবল রাব্বুল আলামিনই জানেন, তিনিই তাঁর সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে রক্ষা করবেন।

একটি রাস্তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী
এখনো ফরিদগঞ্জে একটি পশ্চাদপদ জনপদ। বিশেষ করে অবকাঠামো দিক থেকে থানাটি বাংলাদেশের অন্যতম পেছনে পড়া। যে কেউ শুনলে অবাক হবেন ফরিদগঞ্জে এ মুহূর্তে ১১৭১ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ৪০০ কিলোমিটার পাকা করা হলেও চোর কন্ট্রাকটর কাজ করেছিল ফলে অল্প দিনে আবার চলাচলের অযোগ্য। রাস্তা বলা যাবে না বলতে হবে ইটের কনার ওপর দিয়ে পায়ে চলা পথ। ভাগ্যিস মানুষ এখন আর খালি পায়ে হাটে না তাই ইটের কনার ওপর দিয়েও দিব্যি চলাফেরা করছেন। তবে গর্তে পড়ে কতজনের পা মচকেছে সে হিসেব কারো কাছে নেই। এবার আমি একটা রাস্তার আত্মজীবনী লিখব। মূলত রাস্তা দুইভাগ- প্রজেক্ট একটি। অর্থাৎ এক টেন্ডারে কাজ হবে।
প্রথম রাস্তাটি হলো ফরিদগঞ্জ থেকে রূপসা হয়ে গঙ্গাজলি পর্যন্ত ৫.৭৪ কিলোমিটার।সর্বশেষ এটির টেন্ডার হয়েছে ৮.৭০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় অংশটি হলো পূর্ব সুবিদপুর থেকে বাশারা বাজার হয়ে মুন্সিরহাট বাজার দিয়ে কামতা রাস্তার সাথে মিশেছি-এর টেন্ডার হয়েছে ৮.০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ একটা প্রকল্পের দুটি অংশ।

এখন যে টেন্ডারটি হয়েছে তাতে করে দুটি অংশই চওড়া হবে। ফরিদগঞ্জ-রুপসা-গঙ্গাজলি রাস্তাটি এখন আছে ভাঙ্গাচোরা ১২ ফুট, এর দুই পাশ দিয়ে তিন ফুট করে বাড়িয়ে ১৮ ফুট করা হবে। এবং পূর্ব সুবিদপুর-বাশারা-মুন্সিরহাট-কামতা রাস্তাটি এখন আছে ৮ ফুট-এর দুই পাশ দিয়ে ২ ফুট করে বাড়িয়ে ১২ ফুট চওড়া করা হবে।

রাস্তা দুটি আমার নির্বাচনী এলাকা ফরিদগঞ্জের খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সাড়ে চার লাখ ফরিদগঞ্জবাসির প্রায় দুই লাখ লোক এই রাস্তা দুটি ব্যবহার করে। ইতোপূর্বে এ রাস্তা নির্মাণের জন্য দুইবার টেন্ডার কল করা হয়েছে। এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারদের নানান শর্ত যোগ হওয়ায় কোন কন্ট্রাকটরই টেন্ডার পার্টিসিপেট করেননি। ২০১৮র ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এমপি হবার পর আমি উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাকে জানানো হয় কেউ কাজ করতে চাচ্ছেনা, কিন্তু কেন? প্রশ্ন করলে থানা এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ কোন জবাব দিতে পারেননি। আমার বুঝতে বাকি থাকেনা। কন্ট্রাকটরের লাভ না হলে ডিপার্টমেন্টেরও পকেট ভরবে না। কেননা কয়েক বছর আগের এস্টিমেট অনুযায়ী কাজ করলে লোকসানতো হবেই। একজন কন্ট্রাকটর কেন জেনে শুনে লোকসান মেনে নিয়ে কাজ করবেন।

আমাদের ফরিদগঞ্জের এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বেশ কয়েক বছর থেকে ফরিদগঞ্জে আছেন ৫-৬ বছর হবে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম আপনি একটা রাস্তা করাতে পারলেন না আপনার ফরিদগঞ্জ থাকার কোন জাস্ট ফিকেশন আছে কি? ভদ্রলোক (প্রকৌশলী জিয়াউল ইসলাম) কোন জবাব দিলেন না। তবে ফরিদগঞ্জে কোন অনুষ্ঠান হলে যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি,স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবস,পহেলা বৈশাখ এবং খেলাধুলা সবসময় পরিচালকের মাইকটি তার হাতে থাকে।

কয়েক মাস আগে এ ব্যাপারে আমি আমাদের থানা আওয়ামী লীগ নেতা (যাকে মাননীয় নেএী সভাপতি ঘোষনা করার পরও তিনি কমিটি করতে পারেননি স্থানীয় নেতৃত্বের কারনে) আমির আজম রেজার সাথে রাস্তা দুটি নিয়ে আলোচনা করি।রেজা আমাদের এলাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন এমপি ও সংগঠক আলহাজ¦ রাজা মিয়া স্যারের ছেলে। ( সেও ফাস্ট ক্লাস কন্ট্রাকটর) বললেন, ৩/৪ বছর আগের এস্টিমেটে কাজ করা যাবে না,ওভার দিয়ে অর্থাৎ কস্ট বাড়িয়ে দিলে কাজ করা যাবে। তারপরও রেজা নিজে কাজ করতে রাজি হ”িছলেন না।আমি বুজিয়ে তাকে রাজি করাই।তখন শিউলী হরি নতুন ইউএনও হিসেবে ফরিদ্গঞ্জে আসেন। তার কক্ষে আমির আজম রেজাকে নিয়ে আমরা বসি। এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ারকে সরাসরি বলি হাংকি-পাংকি বুজিনা, রেজা সাহেবের সাথে আলোচনা করুন কত এভবে তিনি কাজ করতে পারবেন। রেজা সাহেব বলেছেন ২০% এভবে হলে তিনি কাজ করতে রাজি আছেন।ইউএনও শিউলি হরি এবং এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার জিয়াউল ইসলামকে বললাম রেজা সাহেবের ডিমান্ড অনুযায়ী টেন্ডার কল করে কাজ তাকে দিতে। এতে যদি কোন সরকারি খড়ক আসে বা মামলা হয় সে দায়িত্ব আমার। আমি এলাকার নির্বাচিত এমপি। জেল-জরিমানা হলে আমার হবে কিন্তু আগামী ৬ মাসের মধ্যে জনগণের চলার পথ পাকা হতে হবে।

তখন এলো আরেক সংকট ৩নং টেন্ডারের মেয়াদ শেষ এখন ৪নং টেন্ডার কল করতে হবে। পড়লাম আরো এক মাসের ফেরে।বললাম টেন্ডার ছাড়া কি করা যায় না আমি দায়িত্ব নেব। তারা রাজি হলো না। বলল সুযোগ নেই। ৪নং টেন্ডার হলো, আমির আজম রেজা কাজ পেলেন ঐ ২০% এভবেই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা এবার বললেন সিকিউরিটি মানিও ২০% জমা দিতে হবে। তখন আমি রেজাকে নিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার-পিডি অফিসে গেলাম বললাম ২০% দিতে হবে কেন? এটা কাজ ডিলে করার কারসাজি। ১০% সিকিউরিটি দিয়ে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দিন।বললাম এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (এমপি) হিসেবে দায়িত্ব আমার।তারপরও আমাকে তিনবার আগারগাঁও এলজিইডি অফিসে যেতে হয়েছে।সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এবং রেজাকে দিয়ে ১০% সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে যখন কাজ শুরু করার পর্যায়ে তখন এল জীবনঘাতি দানব করোনা ভাইরাস।এখনতো ঘরে বসে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

গ্রামে কীভাবে কাজ হয় তার আরেকটি উদাহরণ হলো ফরিদগঞ্জের পুর্বাঞ্চলে সেচ প্রকল্পের বেড়ি বাঁধ যা রিজিওনাল হাইওয়ে,তা থেকে বাগপুর গ্রামের নারায়ন স্যারের বাড়ি হয়ে ভেতরে খুব ছোট একটি রাস্তা ।এখানে বেড়িবাঁধ বা রিজিওনাল হাইওয়ে থেকে নারায়ন স্যারের বাড়ি যাবার জন্যে একটি ছোট্ট পুল ৩০/৪০ মিটার হবে,তাও হয়নি।২০০১ সালে আমি প্রথমবার নমিনেশন নিয়ে স্যারের বাড়ি যাবার পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম নির্বাচিত হলে পুলটি নির্মান করে দিব।সেবার জিততে না পারলেও সেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম।বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে স্যারের বাড়ি যাবার পর বলেছিলাম আর আপনাদের বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার করতে হবেনা বা ভেতরের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবেনা ।১৫ মাস চলে গেছে এখনো পুল-রাস্তা কোনোটাই হয়নি।থানা ইঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞেস করলে বললেন জনপ্রতিনিদির (এমপি) নামে থোপ বরাদ্দ থেকে কাজটা করতে হবে একনেকে অনুমোদন হবার পর , অর্থাৎ আগামী জুলাই-আগস্টের আগে কাজ শুরু করা যাবেনা। জিজ্ঞেস করলাম, বিগত অর্থবছরেও-তো থোক বরাদ্দ ছিল, তখন হলোনা কেনো?
কোনো উত্তর নেই।
এই হল গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ণ কাজের গতি-প্রকৃতি।

গত ১৫ মাসে আমার অবিজ্ঞতা হল আমাদের থানা প্রশাসন অর্থাৎ যে প্রশাসন রয়েছে তারা সরকারের বাইরের অথবা সরকারের ভেতরের অপশক্তির হয়ে কাজ করছে। তারা বুঝে ফেলেছে আমি যতদিন আছি ততোদিন পারসেন্টেজের কাজ চলবেনা।অতএব যতটা সম্ভব কাজ ডি-লে করতে হবে।

প্রথম প্রথম আমি যখন সরকারি বরাদ্দ নিয়ে প্রশাসনের সাথে বসলাম তখন একজন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ করলাম না) রাখডাক না করে সরাসরি আমার কাছে পারসেন্টেজ দাবি করলো।জানতে চাইলাম –এটাই নিয়ম না-কি?
বললো ,এভাবেইতো চলে আসছে।তাতে এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানেরও পার্সেন্টিজ আছে।

ফরিদগঞ্জে এক ডজনের মত জলাভূমি রয়েছে খাশ। এগুলো মাছ চাষের জন্য লিজ দেয়া হয় বছর বছর। প্রশাসনের সেই কর্মকর্তা আমার কাছে অন্তত তিনটির লিজ চাইলেন।আমি যখন কোন ব্যাপারেই ওদের প্রস্তাবে রাজী হলাম না, প্রত্যাখ্যান করলাম তখন দেখলাম কিছু রাজনৈতিক নেতা চেয়ারম্যান তার সাথে মিলে গেছেন। কিন্তু কিছুতেই আমাকে নমনীয় করতে না পেরে ট্রান্সফার নিয়ে ফরিদগঞ্জ থেকে চলে গেছেন। এখন-তো আর কোন কাজই করা যাচ্ছেনা। করোনা ভাইরাসের কারণে। এই মারণাস্ত্র ভাইরাসের প্রধান প্রতিশোধক হলো সতর্কতা এবং কারো সাথে হাত না মেলানো, আধঘন্টা পর পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সেনাটাইজার মাখানো এবং অবশ্যই বাড়িতে একাকী অথবা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা।আমি গত ১৯ মার্চ এলাকায় গিয়ে কর্মীদের এভাবে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে এসেছি। তারা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করে চলেছেন। গত রবিবার আমার এলাকার ৬ নং ইউনিয়ন থেকে পারভিন নামে এক ভদ্রমহিলা জানালেন তারা খুব গরীব দুইদিন যাবত ঘরে খাবার নেই। সঙ্গে সঙ্গে আমি খাজে আহমেদ মজুমদার আর হেলালউদ্দিনকে জানালে তারা সঙ্গে সঙ্গে এমপি নামের বরাদ্দ থেকে ১০ কেজি চাল, ২ কেজি ডাল, ৩ কেজি পেঁয়াজ, একটা সাবান-এর ৬ টি প্যাকেট নিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি মানুষগুলো খুব গরিব। কর্মীরা ওদের এক সপ্তাহের খাবার দিয়েছেন। এক সপ্তাহ পর আবার যাবেন।

কিন্তু একটা সংকট হলো আমাদের এলাকায় এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রবাসী দেশে ফিরেছে। ইউএনও শিউলি হরি অবশ্য জানালেন সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সমস্যা হল এই লোক গুলো কিছুই মানতে চাচ্ছেনা।তারা দোকানে দোকানে আড্ডা বাজারের দিন গায়ে গায়ে লাগানো লোক। মাইকিং করেও তাদের থামানো যাচ্ছেনা। ইউএনও জানালেন ব্যক্তিগতভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে। তারপরও তারা কিছুই মানছেন না। এই সুযোগ বিয়ের অনুষ্ঠানও আয়োজন করছে।

ঢাকা- ০২ এপ্রিল ২০২০
লেখক- এমপি
সদস্য- মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি
সাবেক সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
ই-মেইল- balisshafiq@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)