চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপিত হয় যেভাবে….

অ্যাড. সলিমউল্যা সেলিম :
মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ব্যাপ্তি ব্যাপক ও বিস্তৃত। সংক্ষেপ করা খুবই কঠিন। শুধু একটা কথা এমন যে, বাংলাদেশের সুমহান স্বাধীনতার বীজ রোপন করা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের শহীদদের তাজা প্রাণের বিনিময়ে। ছালাম, বরকত, রফিক জব্বার ১৯৫২ সালে জীবন না দিলে আজ হয়তোবা ইতিহাস অন্যরকম হতো। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রাপ্তি বিশাল এক মহিরূহ। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি ৪জন তাজা তরুন পাকিস্তান শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের ভাষা আন্দোলনের মিছিলে নৃশংষভাবে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ছালাম, বরকত, রফিক, জব্বারকে। বাংলার (তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ খুন হওয়া ৪জনকে শহীদী মর্যাদা দিয়ে হৃদয় মন্দিরে স্থান দিয়েছে। অনেক দিবস যেমন বাংলাদেশে পালিত হয় তেমনী অনেক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে আমাদের অংহকার এই যে, মহান শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি যেমন বাংলার আবালবৃদ্ধ বণিতা সর্বস্তরের মানুষ শহীদদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এবং সমগ্র বাংলাদেশীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ঢল নামে শহীদ মিনার প্রাণে আবার প্রতিটি অবোধ শিশু কিশোর নিজেরা বাসার সামনে রাস্তার পাশে শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। প্রতিটি বাংলাদেশী ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি এই হৃদয়স্পর্শী গানটি আপন মনে গাইতে থাকে এ যেন ভাষা আন্দোলনকে মনের গভীরতা দিয়ে লালন করা এবং এর চেতনাকে ধারন করা। একুশের চেতনাই টিকে থাকবে আমাদের সুমহান স্বাধীনতা হাজার বছর ধরে।

বাংলাদেশে প্রথম শহীদ মিনার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মিত হয় কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকাসহ বড় বড় শহর নগরে কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ মিনার নির্মিত হলেও কোন জেলা শহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মিত হয় নাই। তাই আমি বহু পূর্ব থেকেই চাঁদপুর একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করার কথা ভাবতে থাকি এবং প্রগতিশীল অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাই। যাদের সাথে যখনই আলাপ করেছি প্রত্যেকেই আমার প্রস্তাবনায় একমত পোষন করলেও সুন্দর একটি জায়গার অভাবে উদ্যোগ নিতে পারি নাই বা উদ্যোগ নেয়া হয়ে উঠে নাই। আমি চাঁদপুর একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সুপ্ত আশা নিয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকি এবং চিন্তা করতে থাকি যে, এমন এক যায়গায় শহীদ মিনার নির্মণ করা উচিৎ যেখান দিয়ে প্রতিনিয়ত সর্ব সাধারণের দৃষ্টি পড়বে শহীদ মিনারের দিকে যাতে শুধু এক দিন নয় সারা বছর মানুষ মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবে।

অতঃপর আমার নাগালের মধ্যে সুযোগ এসে গেলো। আমার বাসার সামনে রেলওয়ের একটি ভরাট মাঠ ঘর থেকে বের হলেই দেখি খালি পড়ে আছে। গুরু ছাগলের অবাধ বিবরণ বাচ্চাদের খেলার একটি জায়গা অনেকটা পতিত নোংরা ভূমির মত। এই স্থানটিতে চাঁদপুর অডিটরিয়াম নির্মাণ করার জন্য চাঁদপুর শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন সেক্রেটারি বাবু অজয় কুমার ভৌমিক এই ডোবাটি বালি দিয়ে বহু টাকার বিনিময়ে ভরাট করেন। ১৯৯৮ইং সনে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাছিনা উক্ত স্থানটিতে চাঁদপুর অডিটরিয়াম নির্মাণের উদ্দেশ্যে একটি ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন যাহা এখানো আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর বাংলাদেশের স্থাপত্য বিভাগ থেকে রেললাইনের পাশে গুরুত্বপূর্ণ ভারী স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না মর্মে মতামত দিলে এখানে অডিটরিয়াম নির্মাণ কাজ কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেন। যাহার ফলে উক্ত স্থানটি আবারো পতিত ভূমি হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে অপর দিকে চাঁদপুরের একটি স্বার্থান্বেষী মহল বর্তমান শহীদ মিনারের এই স্থানটিতে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে একটি মার্কেট করার জন্য যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন। আমি অত্র স্থানে জাতীয় ঐতিহ্যের কোন স্থাপনা ছাড়া অন্য কোন কাজে উক্ত স্থানটি ব্যবহার হোক তাহা কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না। কারণ উক্ত (বর্তমান শহীদ মিনার স্থান) স্থানের পাশে হাছান আলী হাইস্কুলের ঐতিহাসিক মাঠ যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে চাাঁদপুরের দামাল ছেলেরা বাঁশের লাঠি হাতে বা থ্রি নট থ্রি গদা রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ট্রেনিং করেছিল এবং হাছান আলী হাইস্কুল মাঠে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনমত গঠনের জন্য বিশাল বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তারই সামনে চাঁদপুরের ঐতিহ্য সুন্দর্য একটি লেকের মধ্যখানে মহান স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক ভাস্কর্য্য “অঙ্গীকার” নির্মিত হয়েছে আর তার পাশে মার্কেট হবে অসম্ভব ! মনে মনে স্থির করলাম উক্ত স্থানেই বাংলার ঐতিহাসিক স্মারক ছিন্ন “চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করবো”।

চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শীহদ মিনার নির্মাণ করার সময়ে দেশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এবং চাঁদপুর সদরের তখনকার এমপি এস.এ সুলতান টিটু। আমি এমপি মহোদয়কে আমার ভাবনার কথা জানানোর সাথে সাথে এমপি মহোদয় আমাকে আন্তরিকভাবে সমর্থন দিলে আমি এমপি সাহেবকে বর্তমান চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থানটি পরিদর্শন করাই। এমপি মহোদয় স্থানটি দেখে বিষয়ে সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মর্মে সম্মতি দিলে আমি চাঁদপুর জেলা প্রশাসক (তৎকালীন) আবদুর রব হাওলাদার ও পুলিশ সুপার বখতিয়ার আলমকে বিষয়টি জানালে তারাও আন্তরিকভাবে আমার ভাবনাকে সমর্থন জানালে আমি এমপি মহোদয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে আরো অবগত করি যে, আগামী জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মিটিং এ অত্র বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করবো মর্মে আগ্রহ প্রকাশ করি। তৎপর সেই মহেন্দ্রক্ষণ আসে ২০০৪ সনের জানুয়ারি মাসের চাঁদপুর উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা আমি সদস্য হিসাবে অঙ্গীকারের পাশে এবং মহান স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক হাছান আলী হাই স্কুল মাঠের কাছে তৎকালীণ বালুর মাঠে চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করার প্রস্তাবটি বিনয়ের সাথে উত্থাপন করলে উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির উপস্থিত সকল সদস্যগণ প্রস্তাবের ভূয়সী প্রশংসা করে সমর্থন জানালে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় এবং জানুয়ারি মাসের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মিনুটসে গৃহীত প্রস্তাব হিসাবে রেকর্ড করা হয়, একই সাথে একই মিটিং এ সকলের সর্বসম্মতিক্রমে চাঁদপুরের তৎকালীণ জেলা প্রশাসককে সভাপতি এবং আমি অধমকে (লেখক) সাধারন সম্পাদক করে চাঁদপুরের গণ্যমান্য সচেতন প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ ও সকল রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটির সভাপতি সাধারন সম্পাদককে সমন্বয়ে ২১ সদস্যের চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত নির্মাণ কমিটি দফায় দফায় মিটিং করে শহীদ মিনার নির্মাণ করায় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হয়। উক্ত শহীদ মিনার ও বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় বহু লক্ষ টাকা। উক্ত টাকা তৎকালীণ চাঁদপুর জেলাধীন প্রত্যেক বিএনপি দলীয় এমপি মহোদয়গণ, চাঁদপুর জেলা পরিষদ, চাঁদপুর পৌরসভা, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা এবং ব্যক্তিগতভাবে স্বনামধন্য কৃতিসন্তান যাদের নাম আজ শেষপ্রান্তে হলেও উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই উল্লেখ করতে হয় শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক (বর্তমান আহ্বায়ক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি), বিশিষ্ট শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব এম.এ হান্নান, বিশিষ্ট সমাজসেবক দানশীল ব্যক্তিত্ব শাহাবুদ্দীন অনু, ড. মোঃ সবুর খান ভাল অংকের অনুদান দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অতঃপর শহীদ মিনারটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং আরো সুন্দর্য বর্ধনের জন্য যিনি সর্বশেষ অবদান রেখেছেন তিনি চাঁদপুর পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র আলহাজ্ব নাছির উদ্দিন আহমেদ। শহীদ মিনারটি নির্মাণে যারা আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এস.এ.সুলতান টিটু (সাবেক এমপি), সাবেক জেলা প্রশাসক আঃ রব হাওলাদার, সাবেক পুলিশ সুপার বখতিয়ার আলম অতঃপর সাবেক জেলা প্রশাসক মোঃ তাহেরুল ইসলাম এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব আলহাজ্ব সফিউদ্দিন আহ্মেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আঃ হামিদ মাস্টার, বাবু জীবন কানাই চক্রবর্তী, অ্যাড. আঃ লতিফ শেখ, অ্যাড. জহিরুল ইসলাম, অ্যাড. বিনয়ভূষণ মজুমদার প্রমুখ। শহীদ মিনার নির্মাণে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সকল সাংবাদিকবৃন্দ শুধু উৎসাহ যোগননি আমাকে সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছেন। গত ২০০৫ সাল থেকে চাঁদপুরের মানুষ চাঁদপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাণখুলে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করতে শুরু করেন। অতএব আমি উপরে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসন, সাংবাদিক সমাজ ও চাঁদপুরবাসীর কাছে আজ ভাষার মাসে আন্তরিকভাবে কৃজ্ঞকতা জানাচ্ছি এবং বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান শহীদদের স্মরণ করছি। সাথে এও দাবি জানাচ্ছি যে, অত্র শহীদ মিনারসহ মহান স্বাধীনতার যত স্মারক স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁদপুরের প্রথম শহীদদের নামে নির্মিত (ট্রাক রোডে) মুক্তিসোধ, ভাস্কর্য্য অঙ্গীকারসহ সকল স্মারক চিহ্নগুলির সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম গুলি সরকার বাহাদুরকে পরিচালনা করতে হবে।

লেখক পরিচিতি : অ্যাড. সলিম উল্যা সেলিম, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)