চাঁদপুরে লোকবল ও ট্রেন সংকটে ধুঁকছে রেল বিভাগ

তালহা জুবায়ের :
চাঁদপুরে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম রেলপথ। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগের এই মাধ্যমটি আজ নানা সংকটে জর্জরিত। প্রয়োজনীয় লোকবল ও ট্রেন সংকটে রেল বিভাগ টিকে আছে না থাকার মত। ইতিমধ্যে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি স্টেশনে।

২০১২-১৩ অর্থ বছরে লূপলাইনসহ চাঁদপুর-লাকসাম রুটের ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ পুনঃস্থাপনসহ ১১টি স্টেশন ভবন ও ছোট বড় ৫৭টি ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণে ব্যয় হয় ১০৬ কোটি টাকা।
সেবা বঞ্চিত মানুষে দাবি, চলাচলে সস্তি ফিরিয়ে আনতে লোকবল নিয়োগের পাশাপাশি বৃদ্ধি করা হোক ট্রেনের সংখ্যা। রেল কর্তৃপক্ষ বলছেন, সর্বোচ্চ যাত্রী সেবা প্রদানে সর্বাত্বক চেষ্টা করছেন তারা। দিয়েছেন সংকট নিরসনে দ্রæত উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস।

বৃটিশ শাসন আমলের শুরুর দিকে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর তীরে গড়ে উঠে পুরানবাজার বাণিজ্য কেন্দ্র। তখন রেলপথ প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও বিস্তৃতি লাভ করে। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠে রেলপথ। এক সময় এই অঞ্চলে ৮ জোড়া ট্রেন চলাচল করলেও বর্তমানে চলাচল করে মাত্র দুটি ট্রেন।

চাঁদপুর স্টেশন। মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত সর্ব শেষ ট্রেন স্টেশন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্টেশনটিতে পরিবহন ও বাণিজ্য বিভাগে বিভিন্ন সেক্টরে ৮০টি পদ থাকলেও নিয়োগকৃত জনবল রয়েছে মাত্র ১০জন। বাকি ৭০টি পদেই রয়েছে জনবল সংকট।এরমধ্যে পয়েন্টস ম্যানের ১২টি পদের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৩জন, বুকিং সহকারী পদের ৫জনের মধ্যে রয়েছে ২জন এবং ২জন সহকারী স্টেশন মাস্টার থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ১জন। এতে করে ব্যহত হচ্ছে যাত্রীদের প্রত্যাশিত সেবা দান কার্যক্রম।

চাঁদপুর রেলওয়ের পয়েন্টস ম্যান ইয়ার সাহাবুদ্দিন বলেন, পয়েন্টস ম্যান পদ ১২টি থাকলেও আমরা মাত্র ৩জন কাজ করছি। যেই কাজে যাকে নেওয়া দরকার তাকে যাচাই না করে নিয়োগ দেওয়ায় কারণে রেল চলাচল বিঘ্নহয়।

চাঁদপুর রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার সোয়াইবুল সিকদার বলেন, স্বল্প জনবল দিয়ে অনেক কষ্টকর হয়ে যায় যাত্রী সেবা নিশ্চিতে। তারপরেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাত্রীদের সেবা দিতে। সহসায় জনবল নিয়োগের কথা রয়েছে। জনবল নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে গেলে আশাকরি আরো বেশি সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।

এক সময় চাঁদপুর থেকে লাকসাম, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচল করতো ট্রেন। যাত্রী চলাচলের পাশাপাশি পরিবহণ করা হতো ইলিশ মাছসহ নানা পণ্যদ্রব্য। এতে করে সরকারের কোষাগারে জমা হলো বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, পাশাপাশি চাঙ্গা ছিল এই অঞ্চলের অর্থনীতি। কিন্তু ২০০৫ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় অধিকাংশ ট্রেন। ২০১৩ সালে কমিউটার ডেমো ট্রেন চালু করা হলেও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে তা চ‚ড়ান্ত ভাবে বন্ধ হয় ২০২১ সালে। বর্তমানে আন্তঃনগর মেঘনা এক্সপ্রেস ও বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় লোকাল সাগরিকা নামে দুটি ট্রেন চলাচল করছে। তবে, দীর্ঘ ৩৯ বছর যাবত মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি জড়াজীর্ণ কোচ নিয়ে চলাচল করলেও লাগেনি আধুনিকতার ছৌঁয়া। ট্রেন সংখ্যা কমে যাওয়ায় চলাচলে বিপাকে পড়ছে যাত্রী সাধারণ।

ওয়ারুক এলাকার বাসিন্দা তারেক হোসেন বলেন, আমাদের স্টেশনে নতুন ভবন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এর কোন সুফল ভোগ করতে পারছিনা। সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে নতুন ভবন তৈরি করে ফেলে রাখায় তা নষ্ট হয়ে এখন পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। লোকবল না থাকায় আমরা কোন সুফলই পাচ্ছি না।

চাঁদপুর-লাকসাম সেকশনে ৫২ কিলো মিটার রেলপথে স্টেশন রয়েছে মোট ১১টি। এরমধ্যে ৬টি স্টেশনে কার্যক্রম থাকলেও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে মৈশাদী, শাহতলী, বলাখাল ওয়ারুক ও শাহরাস্তি স্টেশন। অথচ ২০১৬ সালে মৈশাদী, শাহতলী, মধূরোড ও বলাখাল স্টেশনে নির্মাণ করা হয় নতুন ভবন। লোকবল সংকটে অব্যবহৃতই রয়ে গেছে স্টেশনগুলো। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্টেশনগুলো পরিণত হচ্ছে পরিত্যাক্ত ভবনে। স্টেশনগুলোতে ট্রেন না থামায় জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে রেল লাইনগুলো। স্টেশনগুলো সচল করতে দ্রুত জনবল নিয়োগের দাবি যাত্রীদের।

চাঁদপুর শহরের কালী বাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল হোসেন বলেন, আগে অনেক ট্রেন ছিল। মানুষ সহজেই যাতায়ার করার সুযোগ পেত। কিন্তু এখন মাত্র দুই ট্রেন রয়েছে, তাও জরাজীর্ণ। নতুন কোট ট্রেনতো দেয়ই না কোচগুলোও মান্দাতার আমলের। নতুন ট্রেনের পাশাপাশি চাঁদপুর থেকে কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচলের দাবি জানাই।

কুমিল্লা রেলওয়ের উর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার বলেন, যেসব স্টেশন বন্ধ আছে সেগুলো হলো ডি ক্লাস স্টেশন। যেখানে ক্রসিং এর সুবিধা আছে সেগুলো সব চালু আছে। তবে স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে কিছুটা বেঘাত ঘটছে। এসব স্টেশনে লোকবল নিয়োগ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, চাঁদপুর রেলপথের সংকট নিরসনে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। জনবল সংকট কেটে গেলে এবং আমাদের নতুন কোচ ও ইঞ্জিন আসতেছে। এগুলো চলে আসলে ট্রেনের স্বল্পতা থাকবে না। চাঁদপুর থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচলের জন্য একটি ট্রেন দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণে এখনই তা দেওয়া হচ্ছে না। তবে অচিরেই হয়তো এটা চালু হবে।

এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের পাশাপাশি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ট্রেনের সংখ্যা। এতে এক দিকে সহজ যাতায়াত সুবিধার পাশাপাশি গতিশীল হবে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক কার্যক্রম, অপরদিকে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে সরকারি কোষাগারে। তাই কর্তৃপক্ষ আশ্বাসে সীমাবদ্ধ না থেকে সমস্যা সমাধানে কাজ করবে এমনটাই প্রাত্যাশা সাধারণ যাত্রীদের।

শেয়ার করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)