Site icon Chandpur Probaha | চাঁদপুর প্রবাহ

চাঁদপুর সদর হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে নাজুক চিকিৎসা ব্যবস্থা

রহিম বাদশা :
একদিকে ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি রোগী অন্যদিকে চিকিৎসক, নার্স, অক্সিজেনের তীব্র সংকট। তার ওপর করোনা টেস্টের জন্য নমুনা প্রদানকারীদের প্রচন্ড ভিড়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কাঙ্খিত চিকিৎসা ও সেবা না পেয়ে রোগী-স্বজনরা যেমনি দিশেহারা তেমনি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সরাও দীর্ঘকাল ধরে দায়িত্ব পালনে ক্লান্ত-শ্রান্ত-অতিষ্ঠপ্রায়।

চাঁদপুর জেলায় বেসরকারি কোনো হাসপাতালে করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় আক্রান্তরা আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন। মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে তাই অনেকে ঢাকা কিংবা কুমিল্লা ছুটছেন। অথচ উপজেলা হাসপাতালের নবঘোষিত কোভিড ওয়ার্ডগুলোর শয্যাগুলো খালি পড়ে আছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এ জন্য জনগণের অনাগ্রহের কথা বললেও রোগী-স্বজনদের অভিেযোগ, উপজেলা হাসপাতালে করোনার তেমন কোনো চিকিৎসা নেই, অক্সিজেন সেবাও পর্যাপ্ত নয়।

হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও এলাকার আলমগীর হোসেন জানান, গত বুধবার তিনি তার করোনায় আক্রান্ত বোনকে নিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। তার বোনের অক্সিজেন লেভেল ৮৮-৯০ ছিল। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সরা ওই রোগীকে জেলা সদর হাসপাতাল বা ঢাকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিদায় করেন। তিনি খবর নিয়ে দেখেন সদর হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট চরমে। বাধ্য হয়ে বোনকে নিয়ে ঢাকা চলে যান তিনি। সারাদিন চেষ্টা-তদ্বিরের পর রাতে কুর্মিটোলা হাসপাতালে একটি বেড পায় তার বোন।

চাঁদপুর সদর হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গে আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হতে পারলেও প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সেবা পাচ্ছেন না অধিকাংশ রোগী। অক্সিজেনের অভাবে প্রায়’ই রোগী ও তাদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে করোনা ওয়ার্ডের একেকটি কক্ষ কিংবা করিডোর। তাদের সাথে মৃতের স্বজনদের কান্নার রোল একাকার হয়ে যাচ্ছে। কান্নার কারণ পৃথক করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের।

ভুক্তভোগী স্বজনদের অভিযোগ, রোগীর অবস্থা খারাপ হলেই হাসপাতালে আনা হয়। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও একজন ডাক্তারের দেখা মিলে না। এমনকি বার বার চেষ্টা করেও নার্সের সেবা পান না অনেকে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না প্রয়োজনীয় সব ওষুধ। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করে ও ওষুধ কিনে আনতে হয় তাদের। কোনো কোনো রোগী বাইরে থেকে মিটারসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে এনে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে সেই সক্ষমতা সবার নেই, চাহিদা বাড়ায় দামও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের। অক্সিজেন সংকটে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০জন করে রোগী মারা যাচ্ছে গত কয়েক দিন ধরে।

এই দূরাবস্থা পুরোপুরি অস্বীকার না করে নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও ক্লান্তির কথা তুলে ধরেন সদর হাসপাতালের করোনা বিষয়ক ফোকালপার্সন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল। এই আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার বলেন, মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপ থাকায় অনেক কিছুই ঠিকঠাক মতো করা যাচ্ছে না। চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক কিংবা নার্স কতজনকে একযোগে সেবা দিতে পারবেন সেটাও সবাইকে বুঝতে হবে। আসলে হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় স্বজনরা অনেক উদ্বিগ্ন থাকেন। তাই তাদের মধ্যে হতাশাও বেশি কাজ করে।

তিনি জানান, চাঁদপুর সদর হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড সম্প্রতি ৬০ শয্যা থেকে ১২০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। এখানে ডাক্তার নিয়োজিত আছেন ২০জন। প্রতিদিন মর্নিং শিফটে ২জন ডাক্তার ও ৩জন নার্স, ইভিনিং শিফটে ১জন ডাক্তার ও ২জন নার্স এবং নাইট শিফটে ১জন ডাক্তার ও ২জন নার্স নিয়োজিত থাকেন। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ১০ দিন করে ৭জনের টিম পালাক্রমে ডিউটি করেন। আর নার্সদের ক্ষেত্রে টানা ১৫ দিন করে ১৪জনের টিম পালাক্রমে ডিউটি করে। তবে শয্যা দ্বিগুণ করার পর নার্সের সংখ্যাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। নার্স সংখ্যা ২৮জন থেকে ৫৬জন করা হয়েছে। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন মাত্র ২জন। তারাই পালাক্রমে কাজ করেন।

ডা. রুবেল আরো জানান, ১২০ শয্যার বাইরেও প্রতিদিন প্রচুর রোগী আসছে এখন। এ অবস্থায় সিভিল সার্জন জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আরো ৭জন ডাক্তার ও ৭জন নার্স সদর হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে নিয়োগ দিয়েছেন অতি সম্প্রতি। আগামী ১ আগস্ট থেকে তারা সদরে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। তাছাড়া সরকারিভাবে আরো বেশ কয়েকজন ডাক্তার সহসা এখানে পদায়ন করার সম্ভাবনা রয়েছে। অক্সিজেন সমস্যার সমাধানে স্থাপিত লিকুইড অক্সিজেন প্লান্ট চালুর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। আগামী ২/১ দিনের মধ্যে এই প্লান্ট চালুর কথা রয়েছে। তখন আর অক্সিজেন সমস্যা থাকবে না।

তিনি আরো বলেন, আমরা নিজেরাও এখন ক্লান্ত। দীর্ঘদিন ধরে করোনা রোগীদের সেবা দিতে যেয়ে আমাদের অনেক ডাক্তার ও নার্স ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়ে তারা আবার কাজে ফিরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে রোগীর চাপ এত বেড়ে গেছে যে আমরা নিজেরাও এখন সব রোগীকে প্রত্যাশিত চিকিৎসা ও সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। জীবন বাজি রেখেই মানবতার সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছি আমরা।

এ ব্যাপারে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, মানুষজন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে যেতে চায় না। এ কারণে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে মাত্রাতিরিক্ত ভিড় হচ্ছে। এতে এখানে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা ও সেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা বেড ও চিকিৎসা-নার্স বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি উপজেলা হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি বাড়ানোর নানামুখী চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

তিনি জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সাথে বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জনদের অনুষ্ঠিত বৈঠকে চাঁদপুরের অক্সিজেন, চিকিৎসক-নার্স সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। মন্ত্রী দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। তাছাড়া চাঁদপুর সদর আসনের এমপি ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে নিয়মিত চেষ্টা-তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে এসব সমস্যার সমাধানে। চাঁদপুর সদর হাসপাতালের লিকুইড প্লান্ট রোববারের মধ্যে চালুর সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন করে অনেক চিকিৎসক নিয়োগেরও সম্ভাবনা রয়েছে। অক্সিজেন প্লান্ট চালু হলে ও আরো চিকিৎসক-নার্স দেওয়া হলে বর্তমানে বিরাজমান সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন
Exit mobile version