Site icon Chandpur Probaha | চাঁদপুর প্রবাহ

করোনাযোদ্ধা এক সংগ্রামী দম্পতি

ডা. পলিনকে জেনারেল উপাধিতে ভূষিত করলেন বিভাগীয় পরিচালক

বিশেষ প্রতিবেদক :
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই কঠিন দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবসেবার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন চাঁদপুরের এক চিকিৎসক দম্পতি। একমাত্র সন্তানকে দাদা-দাদীর কাছে রেখে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় করোনাচিকিৎসায় ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন তারা। এমন কঠিন সময়ে সহকর্মীদের অনেকেই যখন আত্মরক্ষায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন তখন মানবসেবার ব্রত নিয়ে করোনাবিরোধী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছেন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল ও ডা. সাজেদা বেগম পলিন দম্পতি। তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা, ধৈর্য্য ও সাহসিকতা অতুলনীয়।

দেশে করোনা সংক্রমের শুরুতেই আইইডিসিআর’র করোনা বিষয়ক প্রশিক্ষণে জেলা থেকে শুধুমাত্র এই দু’জন চিকিৎসক অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরো কয়েক দফা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তারা। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি, পদ্ধতির সাথে আন্তরিকতা ও সাহসিকতার মিশেলে নিজেদের মেলে ধরেছেন জনকল্যাণে।

চাঁদপুর জেলায় করোনার রোগী বাছাই, নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা বিষয়ে যেসব চিকিৎসকের নাম সর্বোচ্চ ধাপে তাদের মধ্যেও শীর্ষে ডা. রুবেল-পলিন দম্পতি। নিরলসভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন মানবতার এই সেবকদ্বয়। চলমান করোনাযুদ্ধে সমরক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে চাঁদপুরে চিকিৎসকদের মধ্যে শীর্ষযোদ্ধা তারা। সেবা নিতে আসা মানুষ, শনাক্তকৃত রোগী, স্বজন, সহকর্মী ও স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তারাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক তো করোনাযুদ্ধের ‘জেনারেল’ পদে ভূষিত করেছেন ডা. সাজেদা বেগম পলিনকে। ওই পরিচালকের মতে, করোনাযুদ্ধে বিভাগীয় শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসক তথা করোনাযোদ্ধা ডা. পলিন।

ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালের আরএমও হিসেবে কর্মরত। মেধাবী ও পরিশ্রমী এই চিকিৎসককে করোনা বিষয়ক ফোকালপার্সন এবং মেডিক্যাল টিমের প্রধান মনোনীত করেন
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যে শতভাগ সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন।

হাসপাতালের নিয়মিত ডিউটির পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র দেওয়া, শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতাল অথবা বাসায় (আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন) চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান ও চিকিৎসাপত্র দেওয়া, আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রোগীদের বাড়তি নজর রাখা- একাধারে এসব কাজ করতে হয় তাকে। এর পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনসহ আরো অনেকের সাথে কথা বলতে হয়, তথ্য দিতে হয়। পরম ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার সাথে হাসিমুখে এতসব সামাল দিচ্ছেন ডা. রুবেল। এমন নিখুঁত সমন্বয় হয়তো তার পক্ষেই কেবল সম্ভব!

অন্যদিকে তার স্ত্রী ডা. সাজেদা বেগম পলিন চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। চিকিৎসাসেবা দানের ক্ষেত্রে স্বামীর সাথে তার পার্থক্য দু’টো। প্রথমত তার আওতায় কোনো হাসপাতাল নেই। তাই চিকিৎসা পরামর্শ দিলেও ভর্তিকৃত রোগীর বিষয়ে তার কোনো কার্যক্রম নেই। তার বাড়তি কার্যক্রম করোনায় আক্রান্ত/উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লোকের বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি টিম পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা এবং সন্দেহভাজন/আক্রান্ত/মৃতের বাসা-বাড়ি লকডাউন করা।

দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও তার বাড়তি একটি কার্যক্রম এখন পুরো স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ‘কোটিভ-১৯’ নামে একটি ফেইসবুক পেইজ খুলে সেখানে প্রতিদিন ভিডিও লাইভের মাধ্যমে করোনা বিষয়ে তথ্য, পরামর্শ, চিকিৎসা ও সতর্কতা তুলে ধরছেন। সেখানে মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এছাড়া তার আওতাধীন চিকিৎসকদের নিয়ে ২৪ ঘন্টাব্যাপী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে করোনা বিষয়ক টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে চলেছেন। এসব মাধ্যমে মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে। এতে এই স্বাস্থ্যকর্মকর্তার উদ্ভাবনী প্রতিভারও সময়োপয়োগী প্রকাশ ঘটেছে।

এই চিকিৎসক যুগলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ফসল হিসেবে চাঁদপুর জেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলা ও সদর হাসপাতালে (সারা জেলার ৪৬জনের মধ্যে ২৫জন)। রোগী বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা, কাজের পরিধি, দায়িত্ব-কর্তব্য। নিদারুণ অবিরাম পরিশ্রমের ফলে শারীরিকভাবে কাতর হলেও মনের জোরটা এখনো ধরে রেখেছেন তারা। তবুও ক্লান্তি ভর করে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। সেই ক্লান্তি না লুকিয়ে শনিবার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তো ডা. রুবেল লিখে বসলেন- ‘আর পারছি না…এত লোড…’।

কিন্তু পরক্ষণে এই প্রতিবেদকের সাথে বক্তব্য প্রদানকালে সেই ক্লান্তির লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। বরং বললেন, আসলে চাকুরি বলেই নয়, মানবিক কারণে ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও কাজ করে যাচ্ছি। কাজের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হলো লোকজন তাদের সব উপসর্গ বলতে চায় না। এতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে। টানা ডিউটির পর বাসায় গেলে জরুরী প্রয়োজনে আবারও আসতে হয়। সেটা দিনে হোক আর গভীর রাতেই হোক। সবচেয়ে বেশি মিস করি আমাদের সন্তানকে। ভাগ্যিস, আমার বাবা-মা বাসায় আছেন। তাই তাদের কাছে সন্তান রেখে আমরা দু’জন মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। খারাপ লাগে, ক্লান্তিও আসে, আক্রান্তের ঝুঁকিও আছে, তবুও এখান থেকে পিছু হটার সুযোগ তো নেই! মানবসেবার ব্রত নিয়েই তো ডাক্তার হয়েছি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার গত ৬ মে চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে করোনাযুদ্ধের জেনারেল উপাধি দেন। এদের মধ্যে ডা. সাজেদা বেগম পলিন অন্যতম। চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহও ডা. পলিনের সাহসী ও নিরলস সেবার প্রশংসা করে তার প্রতি স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

ডা. পলিন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আসলে কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, কখন দিন যায়, রাত পার হয়- তা সব সময় টের পাই না। সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের পাশাপাশি এখন ১৫ ওয়ার্ডের চাঁদপুর শহরটিও দেখতে হয়। কষ্ট তো হয়, খারাপও লাগে। ছেলেটাকে অনেক মিস করি। এখন আর আগের মতো সময় দেওয়া হয় না তাকে। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি বাসায়, আমাদের কারণে তারা আক্রান্ত হন কিনা সেই ভয়েও থাকি। বাসায় তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি- এটা যে কত কষ্টের তা বুঝানো যাবে না। আসলেই আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা এখন ক্লান্ত। তবুও নিজেকে শান্ত¦না দেই এই বলে- ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো। মানুষের উপকারে আসতে পারাটা অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। আশায় বুক বাঁধি- এ দুর্যোগ তো স্থায়ী হবে না। করোনা তো একদিন পরাস্ত হবেই। আমরা করবো জয়, একদিন!

Exit mobile version