Site icon Chandpur Probaha | চাঁদপুর প্রবাহ

চাঁদপুরে পোড়া মাটির বালুভূমিতে ভিনদেশী বাহারি ফলের সমারোহ

আল ইমরান শোভন :
একদা সেখানে মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরী করা হতো। ইট পোড়াতে পোড়াতে পুড়েছে ভিটেমাটিও। পরিত্যক্ত সেই ইট ভাটার পোড়া মাটিতে বালু ফেলে সৃষ্টি করা হয়েছে বালুভূমি। পলিহীন সেই বালুভূমিতেই ভিনদেশী দামী, সুস্বাদু ও নজরকাড়া নানান ফল ফলিয়েছেন সাংবাদিক ও কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন। রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তে প্রাকৃতিক জৈব উপাদানে উৎপাদিত হচ্ছে স্বাস্থ্যকর বাহারি সব ফল। এ যেন পাথরে ফুটেছে ফুল!

চাঁদপুরে ঘটেছে এমন কৃষি বিপ্লব। পরিত্যক্ত ইটভাটা এখন সবুজের সমারোহ। সেখানে চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত, কীটনাশকমুক্ত দুর্লভ ও রসালো হরেক প্রজাতির বিদেশী অর্গানিক ফল। এসব ফলের মধ্যে রয়েছে সাম্মাম, রকমেলন, মাস্কমেলনসহ তিন জাতের ব্যতিক্রম তরমুজ। এছাড়া বিদেশী নানা জাতের আম, মালটা, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, ক্যাপসিকামসহ নানা প্রজাতির ফল।

দীর্ঘ ষাট বছর যাবত যেই জায়গাটি একসময় ইটভাটা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাতে এখন সবুজের সমারোহ। ইটভাটার কারণে এলাকার পরিবেশ দূষিত হতো। কিন্তু তিন মাসে বদলে গেছে পুরনো চিত্র। সেখানে পরিত্যক্ত ইটভাটায় সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে রসালো ফলের বাগান।

চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের শাহতলী এলাকায় পৈত্রিক ইটভাটার পরিত্যক্ত জমিতে পরিকল্পিতভাবে দুর্লভ ও রসালো অর্গানিক ফলের চাষাবাদ কার্যকম শুরু করেছেন ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক ও কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন। যাতে তার ব্যয় হয়েছে ২৫ লক্ষাধিক টাকা। জৈব ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে নানা জাতের বিদেশী ফল। পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইটভাটাটি বালি দিয়ে ভরাট করা হয়।

কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন জানান, ঢাকায় একটি প্রথম সারির দৈনিকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি চাঁদপুরে নিজ গ্রামের বাড়ির পরিত্যক্ত দুটি ইটভাটার প্রায় আড়াই একর দূষণযুক্ত জমি মাটি বালি ফেলে দূষণমুক্ত করেছি। সেখানে এসব ফল চাষ শুরু করেছি। আমি এখন কৃষিকাজকে উপভোগ করছি। অনেকটা শখের বসে আমি এই বাগান গড়ে তুলি এবং নাম দিয়েছি ‘ফ্রুটস ভ্যালি’।

এই কৃষি উদ্যোক্তা বলেন, এখানে সর্বাধুনিক সব কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। আমি চাই আমার এই বিষমুক্ত, কীটনাশকমুক্ত অর্গানিক ফল পাইকারি মূল্যে সারাদেশের ক্রেতার হাতে তুলে দিতে।

তিনি জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে আমার ৬০ বছরের পারিবারিক লাভজনক ইটভাটার ব্যবসা স্বেচ্ছায় বন্ধ করি। এই জমিতে পরিবেশবান্ধব সবুজের সমারোহ গড়ে তোলা আসলেই কঠিন ছিল। পুরো ইটভাটা এলাকা এখন সবুজে সবুজে একাকার।

তিনি বলেন, প্রথমবারেই সাম্মাম, রকমেলন, মাস্কমেলনের আশাতীত ফলন হয়েছে। তাই এখন বাজারে সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এসব চাষাবাদ করতে তার এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে এবং তা আগামী তিন মাসেই উঠে আসার সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি।

হেলাল উদ্দিন বলেন, বাণিজ্যিকভাবে লাভ করতে এই কাজে এগিয়ে আসিনি। এদেশের মানুষকে কিছু উন্নত প্রজাতির ব্যতিক্রম ফল খাওয়াতে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক চাষের উদ্যোগ নিয়েছি। খুব শিগগির অনলাইনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ ঢাকার কিছু সুপারশপে বিক্রয় এবং বিদেশে রপ্তানি করা হবে।

হেলাল উদ্দিন জানান, ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেষা এই জায়গাটিতে প্রায় ৬০ বছর যাবৎ ইটভাটা চলছিলো। যা ৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই জায়গাটি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। আর এটির চারদিকে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে এখানে মাল্টা, ওয়াটার মিলন, ক্যাপসি ক্যাম, ড্রাগন, পেঁপে, আম, বরই চাষ শুরু করা হয়। যেগুলোর মধ্যে যত্ন নেওয়ায় ইতিমধ্যে ফল আসা শুরু করেছে।

চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আমি মনে করি, এই এগ্রো প্রকল্পটি হবে এদেশের একটি মডেল ফল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রথমবারের মতো এমন কিছু ফলের চাষ হচ্ছে। যা এতোদিন ছিলো অকল্পনীয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বাগানটি পরিদর্শন করেছি এবং উদ্যোগ সফল করতে সর্বাত্মক সহায়তা করবো।

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, আমি ফলের বাগানটি ঘুরে দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। এখানে বিদেশী বিভিন্ন জাতের ফল দেখেছি। এই ফল বাগানের উদ্যোক্তা কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে, তাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

শাহমাহমুদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপন মাহমুদ জানান, নিচু ও পরিত্যক্ত জমি ভরাট করে যেভাবে পরিবেশবান্ধব ফল চাষ শুরু হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। আমরা এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি এবং যেকোন প্রয়োজনে পাশে থাকার অঙ্গীকার করছি।

বাগানটির পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা আবু হানিফ ও মিন্টু গাজী জানায়, ক্যাপসি ক্যামের ৬টি বেড। যার প্রতিটি বেডে ১’শ ৩টি করে গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতিটি বেড ১শ’ ৩০ ফুট লম্বা ও আড়াই ফুট চওড়া। আর এর ফাঁকে ফাঁকে মাল্টা চাষ করা হচ্ছে। আবার ওয়াটার মিলনের ১টি বেডে ৯০টি করে চারা লাগানো হয়েছে। প্রতিটি গাছ দেড় ফুট দূরে দূরে। আমরা সম্পূর্ণভাবে কৃষি পরামর্শে বাগানটি তীল তীল করে সাজাচ্ছি।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহতলী আদর্শ একাডেমীর সহকারী শিক্ষক নুর মোহাম্মদ বলেন, এখানে এক সময় ইটভাটা ছিল। সেখানে এমন বিদেশী ফলের বাগান গড়ে উঠবে, তা আমরা কখনো ভাবিনি।

ফলের বাগান দেখতে আসা যুবক দুলাল খান বলেন, এই বাগানটি দেখে এলাকার বেকার যুব সমাজ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এতে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আবার অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এমন বাগান তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।

চাঁদপুর সদর উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, বাগানটির সমৃদ্ধি ঘটাতে কেঁচো সারের ব্যবহারসহ সর্বাত্মক প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বৃহত্তর কুমিল্লার মধ্যে চাঁদপুরে এই প্রথম জৈব ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদেশী দুর্লভ ফল চাষাবাদ করে অনন্য নজির স্থাপন করা হয়েছে। শুধু উদ্যোগে নিলে আর সামান্য পরিচর্যা করলেই এ ধরনের ফল বাগান সারাদেশের যে কোনো স্থানে করা সম্ভব।

Exit mobile version