Site icon Chandpur Probaha | চাঁদপুর প্রবাহ

চাঁদপুরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি

ফয়েজ আহমেদ :
চাঁদপুরের বিভিন্ন জনপদেরে মতেো শাহরাস্তিতেও কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য শীতলপাটি। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। এক সময় গ্রামের বাড়িতে অতিথিরা এলে প্রথমেই বসতে দেয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি।

আগে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরে শীতলপাটি বুনন ছিল পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ। বিবাহযোগ্যা কন্যার পাটি বুনন জ্ঞানকে ধরা হতো বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে। গরমকালে শীতলপাটির কদর ছিল বেশ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে।

বর্তমানে যুগের আধুনিকায়নে পাটি শিল্পের স্থান দখল করে নিয়েছে সুরম্য টাইলস, ফ্লোরম্যাট ও প্লাস্টিকের সামগ্রী। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বধু-কন্যাদের নান্দনিক এ কারুকার্য এখন হারিয়েছে জৌলুস। এখন শুধু ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই এই শিল্পটিতে রয়েছেন কেউ কেউ।

উপজেলার নিজমেহার গ্রামের মৃত ছৈয়দ আলীর স্ত্রী আয়েশা বেগম (৯২) জানান, তার মতো শত শত নারী ছেড়ে দিয়েছেন ‘শীতল পাটি’ বানানো। একসময় পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পাটি বুনতাম, এখন আর এসব চলে না।

সরেজমিনে উপজেলার সূচীপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের ফেরুয়া পাটোয়ারি বাড়িতে দেখা যায়, সেখানে কয়েকটি পরিবার ঐতিহ্য ধরে রাখতে শীতল পাটি বুনছে। ওই বাড়ির মৃতঃ ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারির স্ত্রী বিলকিস বেগম (৫২) জানান, আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে অনেকেই পাটি বুনেন। তবে মোস্তাক গাছ (পাটিবেত গাছ) কমে যাওয়ায় পাটি বুনন অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

উপজেলার ফটিকখিরা এস এ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্য লালন করে হাতে তৈরি শীতল পাটি। এখনও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে বাজার ধরিয়ে দিতে পারছি না তাদের। এ জন্য সরকারিভাবে এগিয়ে আসা দরকার। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে এখানকার শীতল পাটি বিদেশে ও রপ্তানি করা সম্ভব।

স্থানীয়রা আরো জানান, শীতল পাটি তৈরির মূল উপাদান (কাঁচামাল) বেতা তৈরিতে অনেক পরিশ্রমের প্রয়োজন। পরিশ্রমের বিপরীতে বাজার দর ভালো না হওয়ায় দিন দিন একেবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তৈরি কারিগররা।

উপজেলার ঠাকুর বাজারের কুটির শিল্প ব্যবসায়ি মোঃ আমীর হোসেন জানান, বাজারে শীতল পাটির চাহিদা থাকলেও বিকল্প পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় তা টিকছে না। একটি নামাজের পাটির দাম ২শ’ ৫০ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা হলেও ১শ’ ২০ টাকা হতে ১শ’ ৫০ টাকার মধ্যে প্লাস্টিকের একটি নামাজের পাটি কেনা সম্ভব।

আবার একটি বড় পাটির দাম ৮শ’ টাকা হতে ১ হাজার টাকার বিপরীতে ৪-৫শ’ টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের পাটি বা ফ্লোরম্যাট কেনা সম্ভব। শীতল পাটি আগে স্থানীয়ভাবে তৈরি ও সরবরাহ হলেও এখন বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। কাছাকাছি কচুয়া ও হাইমচরে কিছু পাটি পাওয়া যায়। এছাড়া বাকী পাটি জেলার বাইরে থেকে ক্রয় করতে হয়।

মেহের ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফারুক আহম্মেদ জানান, শীতল পাটি বুননে মূর্তা বা পাটিবেত গাছ ব্যবহার করা হয়। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঝোপঝাড় বিনাশের ফলে পাটিবেত গাছ কমে যাওয়ায় শীতল পাটির কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় শীতল পাটি তৈরিকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বাজার তৈরি করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরীন আক্তার। তিনি জানান, ২ বছর আগে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাইকা’র অর্থায়নে শীতল পাটি বুনন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানেও এধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে। তবে শীতল পাটি বুননের পর্যাপ্ত কাঁচামাল উৎপাদন না হলে এসব প্রশিক্ষণ কোন কাজে লাগবে না।এজন্য গ্রামাঞ্চলে মূর্তা বা পাটিবেত গাছের উৎপাদন করতে হবে।শীতলপাটির বাজার সৃষ্টিতে বেসরকারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসলে ঐতিহ্যগত এই পণ্যটি ধরে রাখা যাবে।

সচেতন মহলের মতে, গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক বাহক আমাদের পূর্ব পুরুষের তৈরি শীতল পাটি সভ্য সমাজ ও অনাগত জাতির চেনার জন্য হলেও চালু রাখা প্রয়োজন।

Exit mobile version