ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশনের জীবিকা প্রকল্পে হাজারো পরিবারে স্বনির্ভরতা-স্বচ্ছলতা

বিশেষ প্রতিবেদক :
মোসাম্মৎ রাহিমা বেগম। চাঁদপুর সদর উপজেলার কল্যাণপুর ইউনিয়নের রঙেরগাও গ্রামের বাসিন্দা। ২০০২ সালে বিয়ে হওয়ার পর স্বামী-সন্তান নিয়ে তার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০০৪ হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে অর্ধাহারে-অনাহানে দিন কাটাতে হয়েছিল। সংসার পরিচালনার মতো কোন আয়ের উৎস না থাকায় তিনি ২০০৪ সালের শেষের দিকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন।

এরপর ২০১৫ সালে তিনি ‌’জীবিকা’ বাবুরহাট প্রকল্পের নবদিগন্ত তৃণমূল সংগঠনের সদস্য হন। পরের বছর আগস্ট মাসে তিনি জীবিকা বাবুরহাট প্রকল্প থেকে হাঁস-মুরগীর ভ্যাকসিনেশনের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। এলাকার সকল সদস্যদের হাঁস-মুরগী এবং কবুতর ভ্যাকসিন দিয়ে তিনি মাসে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে আয় করেন। তিনি তার জিআরও নবদিগন্ত থেকে ২০/১১/২০১৬ তারিখে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ নিয়ে ৯ হাজার টাকা দিয়ে ৩টি ছাগল ক্রয় করেন। এক বছরে তিনি বড় ছাগল থেকে ৪টি বাচ্চা পেয়েছেন।

সেখান থেকে ৩টি ছাগল ৯ হাজার ২শ’ টাকায় বিক্রি করে ১ হাজার ৮শ’ টাকা দিয়ে ছেলেকে বাবুরহাট হাই স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। ছেলের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার্থে ২ হাজার টাকা দিয়ে একটি বাইসাইকেল ক্রয় করে দিয়েছেন। থাকার ঘরও মেরামত করেছেন। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে জীবিকা-১ প্রকল্পের চূড়ান্ত সমাপ্তিতে যাকাত তহবিলের প্রদত্ত ২০ হাজার টাকা এবং তার নিজস্ব জমাকৃত সঞ্চয় ১১ হাজার টাকাসহ মোট ৩১ হাজার টাকা হাতে পান।

ওই টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি বকনা ক্রয় করেন। বাকী টাকা দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে ছিট কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। কাপড়ের ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে ৪ থেকে থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করেন। ২০২১ সালের মে মাসে তার গাভিটি একটি বাছুর জন্ম দেয়। বাচ্চাসহ বর্তমানে গাভিটির মূল্য ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া বর্তমানে তার ৪টি ছাগল, ৮টি মুরগী এবং ৬টি ডিমপাড়া হাঁস আছে। নিজস্ব পুজি দিয়ে তিনি একটি গরুর ফার্ম করতে চান। ভবিষ্যতে তিনি তার ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চান।

এককথায় বলতে গেলে একসময়ের হতাশাগ্রস্ত অসহায় রাহিমা বেগম এখন স্বনির্ভর ও স্বচ্ছল। তার এই সফলতার পেছনে ছিল ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশনের জীবিকা প্রকল্প। রাহিমা বেগমের মতো এমন হাজার হাজার পরিবারে আশার আলো জ্বালিয়েছে ‌’জীবিকা’ প্রকল্প। মানবকল্যাণে গৃহীত বাস্তবমুখী এই উদ্যোগের স্বপ্নদ্রষ্টা চাঁদপুরের কৃতি সন্তান, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইটি ব্যক্তিত্ব ড. মো. সবুর খান।

প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, জীবন মান বিকাশ কর্মসূচি (জীবিকা) প্রকল্পটি বাবুরহাট অঞ্চলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের ১ম, ২য় ও ৩য় ধাপ পেরিয়ে ৪র্থ ধাপ বর্তমানে চলমান। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়ে এখনো চলমান। এই সময়ে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার প্রকল্পটির সুবিধাভোগী হয়েছে। মোট সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ১১ হাজার ৪৯৯জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৭৬৭ জন ও মহিলা ৫ হাজার ৭৩২জন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, দারিদ্র্য আসলে আপেক্ষিক সংবেদনশীল আবেগ তৈরি করে যা জাতির অভিশাপ হিসাবে বিবেচিত হয়। গরীব মানুষ এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উপায় খুঁজে পায়নি। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে একে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশল সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র গ্রন্থে নির্দেশ দিয়েছেন। যাকাত হলো এমন একটি পরিভাষা যা সম্পদ পরিশুদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটা মুমিনদের জন্য সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এরই ধারাবাহিকতায় ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খানের সহযোগিতায় চাঁদপুরের বাবুরহাটে ‌’জীবিকা-চাঁদপুর’ নামে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে যাকাত পরিচালনার অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান।

তারা আরো জানান, জীবিকা-চাঁদপুর হল একটি সামাজিক উদ্যোগ, যার লক্ষ্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর দ্বারা নির্ধারিত জাকাতের বাধ্যবাধকতাকে উন্নীত করা এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা, গরীবদের সমৃদ্ধি আনার জন্য একটি অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে। জীবিকা-চাঁদপুর বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে জাকাতের সংগঠিতকরণ এবং যথাযথ বন্টন নিয়ে কাজ করে। জীবিকা-চাঁদপুর সঠিক গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার পাশাপাশি জাকাত সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও নিযুক্ত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাকাত তহবিলের সাথে জীবিকা-চাঁদপুর বেশ কয়েকটি সুসংগঠিত প্রকল্প পরিচালনা করছে এবং অনেক ব্যক্তি এবং পরিবারের জীবন পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। ইতিমধ্যে জীবিকা-চাঁদপুর এই জেলায় জাকাতের নিখুঁত ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যাকাত ব্যবহারের সাথে পরিবর্তনের তত্ত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, জীবিকা-চাঁদপুর প্রকল্প এর লক্ষ্য দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং চাঁদপুরের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের জন্য নির্বাচিত এলাকায় উদ্যোক্তা তৈরি করা।

প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানান, জীবিকা কর্মসূচির লক্ষ্য এমন একটি দারিদ্র্যমুক্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠন যেখানে দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে এবং তাদের উন্নততর নৈতিক গুণাবলী ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ হবে। কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ হলো- ১. একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে দুস্থ, বিধবা, অতি দরিদ্র এবং ইয়াতিম ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে দক্ষতা প্রশিক্ষণ, পুঁজি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সম্পদ ও সেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠীর স্থায়িত্বশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও আয়বৃদ্বি করা; ২. স্বাস্থ্যসেবা প্রদান,পুষ্টির উন্নয়ন, সরকারি ও স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্বির মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা; ৩. জীবন দক্ষতা ও সক্ষমতা উন্নয়নে বয়স্ক শিক্ষা এবং শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠীর নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সক্ষমতা বৃদ্বি ও নৈতিক মান উন্নত করা; দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা এবং পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে মানবিক বিপর্যয় রোধে প্রতিবন্ধী, বিধবা,ইয়াতিম, বয়স্ক ও বিপদাপন্নদের সহায়তা প্রদান করা।

কর্তৃপক্ষ আরো জানান, প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফলাফলও অর্জিত হচ্ছে। আয় তহবিল স্থানান্তর, দক্ষতা উন্নয়ন, বাজারে অ্যাক্সেসযোগ্যতা, তহবিল ব্যবস্থাপনা, তৃণমূল সংগঠন গঠন, মূলধন প্রতি আয় বেড়েছে ২ হাজার দরিদ্র ও চরম দরিদ্র পরিবারের, আয় বেড়েছে ১৫০%। মানুষের ক্ষমতা উন্নয়ন, বর্ধিত জীবন দক্ষতা, বর্ধিত সংহতি, স্বউন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবকাঠামো উন্নয়ন, এমবিবিএস ডাক্তার দ্বারা স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মাকে জোর দেওয়া, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সহায়তা লক্ষ্যকৃত সুবিধাভোগীদের জন্য উন্নত ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, রোগের হ্রাস, অপুষ্টি হ্রাস, ১০০% স্যানিটেশন এবং নিরাপদ পানি, হ্রাসকৃত এনএমআর (নিও নেটাল মর্ট্যালিটি রেট), এমএমআর (মাতৃমৃত্যুর হার), উন্নত সুস্থ সমাজ সহজতর হয়েছে। শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, জীবন দক্ষতা উন্নয়ন শিক্ষা ১০০% তালিকাভুক্তি, সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপ, কুসংস্কার হ্রাস, উন্নত সামাজিক সংহতি উন্নত হয়েছে। জরুরী এবং মানবিক সহায়তা, বয়স্ক, অক্ষম, বিধবা, দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন কৌশলকে আর্থিক ও সম্প্রদায় সহায়তা বয়স্ক, অক্ষম, বিধবার আর্থিক দুর্বলতা হ্রাস পাচ্ছে। সার্বিকভাবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের অসহায়-দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে স্বনির্ভর করা হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রুপ লিডারদের গ্রুপ গতিবিদ্যা এবং ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণে ৩৯জন, গ্রুপ লিডারদের জন্য অ্যাকাউন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ ৩৪জন, হাঁস-মুরগি পালন ৬১জন, মোড়া তৈরি ১৩জন, আয় উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার প্রশিক্ষণ ১ হাজার ৫০০জন, হস্তশিল্প (মাদুর) ২০জন, টিকা (মুরগি পালন) ২৮জন, গরু মোটাতাজাকরণ ৩৫৯জন, গাভী পালন ৩১১জন, কৃত্রিম প্রজনন এবং ভ্রূণ স্থানান্তর ৬, দর্জি প্রশিক্ষণ ২৫জন, বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ২০জনসহ মোট ২ হাজার ৭৪১জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

প্রকল্পটি সুবিধাভোগীদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সুবিধাভোগী বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং তারা এই অর্থ বিনিয়োগ করেছেন এবং তাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন পরিবর্তন করেছেন। তাদের আয় গড়ে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে এবং এটি প্রয়োজনীয় ভোক্তা টেকসই এবং পছন্দসই খাদ্য আইটেমের উপর বৃহত্তর ব্যয়ের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতাভুক্ত পরিবারগুলো শিক্ষাবৃত্তি, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তা পেয়ে আসছে।

প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. রুবেল খান বলেন, ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশনের ‘জীবিকা প্রকল্প’ হলো দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য একটি উদ্যোগ। যা চাঁদপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলে স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা দক্ষতা প্রশিক্ষণ, মূলধন সহায়তা, বাজারজাতকরণ সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পুষ্টি কর্মসূচি, সচেতনতামূলক প্রচারণা, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং সুবিধাবঞ্চিতদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তিনি আরো জানান, জীবিকা প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্থিতিশীলতা অর্জন, বাজারজাতকরণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন।

শেয়ার করুন