শরীফুল ইসলাম :
সামনে ইলিশের মৌসুম। আর স্বাদের রাজা ইলিশ। পথে-ঘাটে ইলিশ মাছ বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠে পদ্মার রূপালী ইলিশের নাম। তাই বাজারে সবাই পদ্মার ইলিশ খোঁজে। ভাল স্বাদের ইলিশ খেতে হলে প্রথমে তাজা ইলিশ হতে হবে। আর তা হতে হবে চাঁদপুরের পদ্মা নদীর। আসলেই কি পদ্মার ইলিশ সেরা, নাকি মেঘনা নদীর। আসল ইলিশ ও সুস্বাধু ইলিশ কোনটি এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক, মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য বণিক সমিতির নেতা এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের সাথে। তারা জানালের আসল স্বাদ এবং কোথাকার ইলিশ সেরা।
ইলিশের মৌসুম অনেকেই সর্ষে ইলিশের আয়োজন করেন, কারো ঘরে হয় ইলিশ পোলাও। ইলিশ ভাজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ দো-পেঁয়াজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশের মালাইকারি-এসবও পছন্দ করেন অনেকে। ইলিশকে ঘিরে এসব আয়োজন যেন বাংলার সংস্কৃতিতে একাত্ম হয়ে আছে। কিন্তু ইলিশ না চিনলে এ আয়োজন কি সফল হবে? তাই ইলিশ সর্ম্পকে কিছুটা ধারণা নিয়ে ইলিশ কিনতে গেলে লাভবান হবেন। জেনে নিন কোথাকার কোন ইলিশ সেরা।
মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ইলিশ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ, তারা দেখেই আসল ইলিশ চিনতে পারে। সাগরের ইলিশ আর নদীর ইলিশে সহজে বুজে নিতে হবে, নদীর ইলিশে উজ্জলতা বেশি থাকে আর কিলবনের ফ্যাট এবং রূপালী চকটকতা থাকে। পরিবেশের কারনে ইলিশের কিছুটা ভিন্নতা থাকে। পদ্মা-মেঘনার ইলিশের কোন পার্থক্য নেই। নদী অর্থাৎ মিঠাপানি আর খাদ্যের কারনে স্বাদের পার্থক্যটা আসে। আসল স্বাদের পার্থক্যটি আসে পরিবেশ ও স্বাদের কারণে। মিঠাপানি অর্থাৎ পদ্মা-মেঘনার পরিবেশ এবং খাদ্যের মান ভালো থাকায় এখানকার ইলিশ স্বাদ ভিন্ন। মূলত পদ্মা-মেঘনার উভয় ইলিশের মধ্যেই স্বাদ থাকে। আসলে যে শুধু পদ্মার ইলিশ সেরা সেটি নয়, মেঘনার ইলিশও সুস্বাদু। প্রচলিত কারণে সবাই পদ্মার ইলিশ বলে। পদ্মা-মেঘনা দুটোর ইলিশই স্বাদ রয়েছে।
এই ইলিশ গবেষক বলেন, সাগরের ইলিশ স্বাদ সম্পূর্ণই আলাদা। সেখানে পরিবেশ ও খাদ্যভ্যাসগত পরিবর্তন থাকে। যার কারণে সেই সেখানকার ইলিশগুলো উজ্জলতা কম থাকে ও শরীরে লালচে ভাব এবং দূসর বর্ণের থাকে। এই ইলিশের শরীরে যে মাংসপেশ তৈরী হয় সেখানে গঠনগত পার্থক্য থাকে পদ্মা-মেঘনা নদীর ইলিশের সাথে। যার কারণেই সাগরের ইলিশ স্বাদ কম হয় এবং নদীর ইলিশ স্বাদ ভালো হয়।
ড. আনিসুর রহমান আরো বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজকে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইলিশের উৎপাদন ২০০২-২০০৩ সালে যেখানে ২ লক্ষ মেট্রিক টনেরও নিচে ছিল, আজ সেটি এখন সাড়ে ৫ লক্ষ মেট্রিক টনে চলে আসছে। আমরা আশা করতে পারি, মা ইলিশের ডিম ছাড়ার সুযোগ, অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন, জাটকা সুরক্ষা এবং সর্বপরি সাগরের যে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা চলে সেটি মেনে চলা- এই চারটি যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হতে থাকলে সাড়ে ৫ থেকে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশের উৎপাদন বাড়তে পারে বলে আমরা আশা করি।
আসল ও স্বাদের ইলিশ প্রসঙ্গে চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটের ব্যবসায়ী রুবেল গাজী বলেন, চাঁদপুরের রূপারী পদ্মার ইলিশ চিনার উপায় চোখ থাকবে কালো, মাছটি হতে চড়া, মাথা গোলগাল ছোট। শরীর চকচক করবে। আর সাগরের ইলিশ শরীরে লালচা লালচা লম্বা থাকে। লেজের আকৃতি ভিন্ন। লেজের পাশে পিচলা পিচলা থাকবে। অনেকেই এই বিষয়গুলো না জানার কারনে সাগরের ইলিশ কিনে নিয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতারা এসব জানলে বাইরের ইলিশের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না। অনেক ব্যবসায়ী বাইরের ইলিশ চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বলে বিক্রি করে। আমাদের কাছে সবাই পদ্মার ইলিশ খুজে। মূলত পদ্মা-মেঘনা ইলিশের কোন পার্থক্য নেই।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক রোটা. হাজী শবে বরাত সরকার বলেন, চাঁদপুরের ইলিশের চিনার উপায় আছে। চাঁদপুরের ইলিশ দু’টি কালারে হয়। উপরের কালার হবে কালো আর নিচে অংশে সাদা। শরীরের আকৃতি একটু চেপ্টা, মাথা ছোট গাড় চড়া। গভেষকরা যাই বলুক, আসলে পদ্মার ইলিশই আমাদের কাছে সেরা। এখানে একটি বিষয় হলো, ইলিশ পদ্মা-মেঘনা উভয় নদীতেই চলাচল করে। আর ঘাটে যা আসে আমরা পদ্মার ইলিশ বলে থাকি। আর সাগরের ইলিশ যেটা আমরা লামার ইলিশ বলে থাকি। এই ইলিশ দেখতে লালচা আর টাটকা হয় না। শরীর ঘোলাটে থাকে।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকী বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে ইলিশের সবচেয় বড় ল্যান্ডিং সেন্টার চাঁদপুরে। সারাদেশে এই শহরকে ইলিশের শহর হিসেবেই চিনে। যার কারণে মানুষ একটু বেশি আকাঙ্খা থাকে, এখান থেকে আসল স্বুসাধু ইলিশ ক্রয় করে নিয়ে যাবে। এখানে যে শুধু চাঁদপুরের ইলিশ বিক্রি হয় তা কিন্তু নয়, এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে জেলারা মাছধরে এখানে নিয়ে আসে। মূলত পরিবেশ ও খাবার ভিন্ন হওয়ার কারণে এক এক জেলার ইলিশ এক এক রকম স্বাদ হয়ে থাকে। অনেক ক্রেতারা আসল ইলিশ না চিনে অন্য ইলিশ কিনে হতাশ হচ্ছেন। মূলত আসল ইলিশ চিনে ক্রেতাদের কিনাটাই উচিত।