জাতিসংঘের অধিবেশনে যুদ্ধ স্যাংশন ও সংঘাত পরিহারের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

যুদ্ধ, স্যাংশন ও সংঘাত পরিহারের জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার জাতিসংঘ সদর দফতরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান তিনি। মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যও সকলকে একযোগে কাজ করার জন্য আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারি ও জলবায়ু সঙ্কটের প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য, অর্থায়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন-লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে । বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে জোরদারকরণ, জাতিসংঘের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করার জন্য প্রচেষ্টা ও সাহসী বক্তব্য এবং বৈশ্বিক সঙ্কট উত্তরণে সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সব সময় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসেকে সমর্থন জানায়।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), সন্ত্রাসবাদ এবং সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

গেল বারের মত এবারসহ মোট ১৯তম বারের মতো শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত ভাষণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বোচ্চ বার জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান ও ভাষণ প্রদানের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কেননা ইতোমধ্যেই তাদের বাস্তুচ্যুতির ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলেও আশংকা ব্যক্ত করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের উন্নয়ন চাহিদার কথা বিবেচনা করতে হবে। আমরা ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত তহবিলের জরুরি বাস্তবায়ন চাই। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, লবণাক্ততা, নদী ক্ষয়, বন্যা ও খরা-জনিত কারণে জলবায়ু-অভিবাসীদের দায়িত্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে আমি আন্তর্জাতিক সংহতির আহ্বানও জানান তিনি।

ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য বাংলাদেশ সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ধীরে ধীরে একটি জলবায়ুর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে জলবায়ু সহনশীল দেশে পরিণত হতে কাজ করছি। বাংলাদেশের ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করছে। আমরা আরও টেকসই শক্তির মিশ্রণের জন্য কাজ করছি।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রচারে পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। এই বছর আমরা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৭৫তম বার্ষিকী পালন করছি।

২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিশন ২০৪১-এর আওতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আমার সরকার বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে এমন একটি উচ্চ আয়ের, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং নিত্য নতুন উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত করবে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কটসমূহ আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তবুও উন্নয়ন সহযোগী এবং উন্নত দেশসমূহকে আমাদের এ যাত্রায় তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

এই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকল কর্মসূচি শেষ হয়েছে। এরপর বিকেলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। সবশেষে রাতে নিউইয়র্কের একটি হোটেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দিয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি। এর আগে শুক্রবার সকালে জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাথে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ত্যাগ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখান থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পরদিন লন্ডন পৌছঁবেন। ২ অক্টোবর লন্ডনে তাঁকে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় যোগদান করবেন তিনি। ৩ অক্টোবর লন্ডন থেকে রওয়ানা হয়ে ৪ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা পৌঁছার কথা প্রধানমন্ত্রীর।

শেয়ার করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)