আবু ওসমান চৌধুরী : দেশ মাতৃকায় যার অবদান গৌরবের

শেখ মহিউদ্দিন রাসেল :
একজন আবু ওসমান চৌধুরী | স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলার এক অকুতোভয় সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের সাহসি কমান্ডার ও ভাষাবীর ছিলেন। বাংলাদেশ গড়ার পেছনে যার অবদান গৌরবের। যিনি দেশ ও দশের কল্যাণে স্বাক্ষ্য রেখেছেন। সেই মানুষটিও বিদায় নিলেন আমাদের মাঝ থেকে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন অটুট থাকবে সুগৌরবে সুউচ্চে মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডারের নাম। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নগুলো। সেই সাথে দেশ গড়ার কারিগরগুলোও। যাদের মধ্যে লে: কর্নেল অব: আবু ওসমান চৌধুরী অন্যতমদের মধ্যে একজন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিপদগামী দুস্কৃতিকারীদের হাতে তাঁর স্ত্রী নিহত হন। ১৯৭৫ সালের পর আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জ্ন্য তাঁর গুলশান বাসভবনে দুস্কৃতিকারীরা হামলা করে। তিনি বাসায় না থাকায় প্রাণে বেচেঁ যান। নিহত হন তাঁর স্ত্রী নাজিয়া খানম। তাঁর স্ত্রীও রনাঙ্গনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, ‌ঔষধপত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করেন এবং গোলাবারুদসহ অস্ত্রসস্ত্র পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁকে চাকুরী থেকে অকালীন অবসর দিয়েছেন। দেশ মাতৃকায় কষ্টাজিত ত্যাগও মৃত্যু অবদি বহন করে চলেছিলেন এই মানুষটি। জীবনের বড় অংশটাই কেটেছে বেধনাবিধুর একাকীত্বে। সততার এক জলন্ত প্রতীক হিসেবে নিজেকে অটুট রেখেছেন সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পেয়েও দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য সব লোভই তাঁর কাছে পরাভূত হয়েছে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তাঁর অধীনে মেহেরপুরের অর্ন্তগত বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে নবগঠিত মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহনোত্তর এক প্লাটুন সৈনিক দ্বারা তিনি গার্ড-অব-অনার প্রদান করেন। তখন বৈদ্যনাথতলার নামকরন করা হয় ‘মুজিবনগর’। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে সম্ভাব্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পেরেই তিনি বহু চেষ্টা করে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীতে বদলী নিয়ে ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা চলে আসেন এবং ২৫শে ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ উইং এর অধিনায়কত্ব গ্রহন করেন। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ রাতে ঢাকার বুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও গণহত্যার খবর পেয়ে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সহায়তা নিয়ে ২৬ মার্চ তার বাহিনী সহকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ তার অধিনস্থ এলাকায় ছোটখাটো সংঘর্ষে একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন নিহত হবার পর তিনি তার সীমান্তবর্তী সব সৈন্য চুয়াডাংগায় জমায়েত করে এবং পুলিশ আনসার মুজাহিদ ও সর্বস্তরের জনগনকে মবিলাইজ করে ৩০ শে মার্চ ভোররাতে তিন দিকে আক্রমণ করে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের ২০০ সৈন্য ও ৪ জন অফিসারসহ বিশাল পাকিস্তানী বাহিনীকে দুই দিনের যুদ্ধে সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলাকে শত্রু মুক্ত করেন। ৫ই এপ্রিল ৭১ বিশাখালীর যুদ্ধ, ৭ই এপ্রিল লেবুতলার এ্যামবুশ, ১৪ এপ্রিল গোয়ালন্দ যুদ্ধ, ২৪ এপ্রিল বেনাপোল যুদ্ধ এবং ৩০শে মে ভোমরা বাঁধ রক্ষায় দিন ব্যাপী যুদ্ধে তার সৈনিকরা অসীম সাহস ও দক্ষতার পরিচয় রেখেছে। ২০ শে জুলাই ১৯৭২ তাকে লেঃ কর্নেল রেঙ্কে পদোন্নতি দিয়ে কোরের প্রধান কর্মকর্তার পদে (ডি.এস.টি) হিসেবে পদায়িত করা হয়ে ঐ পদে ৩ বছর চাকরি করার পর ১৯৭৫ সনে ডিসেম্বরের শেষ মূহুর্তে জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁকে অকালীন অবসরে পাঠিয়ে দেন।

৩০ ও ৩১ মার্চ ১৯৭১ সালে চুয়াডাংগা, কুষ্টিয়া অবস্থিত তৎকালীন ইপি’আর ৪র্থ উইং সৈন্যদের স্থানীয় জনগনের সহায়তায় সন্নিবেশিত করে বাশেঁর লাঠি সজ্জিত জনগন ও ৩০৩ রাইফেল সজ্জিত সেনাদের নিয়ে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত সম্পূর্ন অটোমেটিকে সজ্জিত পাকিস্তানি ২শ সৈন্য ৪ জন অফিসারকে ৩দিন আক্রমণ পূর্বক দু’ দিনের যুদ্ধে সর্ম্পূনরূপে ধ্বংস করে কুষ্টিয়াকে শক্রমুক্ত করার এক অসমও দূঃসাহসিক অবদান রাখেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও ঢাকা কলেজের ছাত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এর সংগঠকের প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সনে দক্ষিণ পশ্চিম রনাঙ্গনের গঠন ও অধিনায়কত্ব গ্রহন, পরবর্তীতে ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান (১৯৯৭-২০০০) হিসেবে ও চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (২০১১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত)।

অবসর জীবনে নিজকে অবসর না রেখে তিনি ১৯৯২ সনের ৭ মার্চ তাঁর লিখিত ইতিহাস, পুস্তক “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” জাতীকে উপহার দেন, যা অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রামান্য পুস্তক হিসেবে ১৯৯৩ এর জাতীয় ইতিহাস কর্তৃক পুরস্কৃত হয় এবং ঐ বৎসরই তাঁকে আলাওল সাহিত্য পুরষ্কার প্রদান করা হয়। সাংবাদিক ও শিল্পসমালোচক রফিকুল ইসলাম তাঁকে লিখিত He Fought for the Motherland নামক স্বল্প দৈর্ঘ্য প্রামান্যচিত্র অসলো থেকে স্বর্ণপদকে পুরস্কৃত করেন। তাঁর নিজ থানা ফরিদগঞ্জ সদরে তিনি একটি অপূর্ব দৃর্ষ্টিনন্দন ‘ফরিদগঞ্জ স্মৃতিস্তম্ভ’ তৈরী করেন।

‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামক ১৯৯২ সালের ৭ই মার্চ তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি ১৯৯৩ইং সনের বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ ও আলাউল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন। এক নজরে ফরিদগঞ্জ, ১৯৯৬ সালের ১৯ এপিল সময়ের অভিব্যক্তি, ২ জুলাই, ১৯৯৬ সালে সোনালী ভোরের প্রত্যাশা, ২ আগষ্ট, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু শতাব্দীর মহানায়ন নামে তাঁর বইগুলো প্রকাশ পায়। তিনি ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত হন। ২০১২ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ঢাকা কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পুরস্কৃত হন, ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি কর্তৃক সম্মাননা ও স্বর্ণ পদক পান এবং ফরিদগঞ্জ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত হন।

২০০৭ সাল থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ১৯৭১ বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ টেনিস ফেডরেশনের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেনিস প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ঢাকাস্থ ফরিদগঞ্জ থানা সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু ডিগ্রী কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি (১৯৯৯-২০০১) পর্যন্ত, ঢাকাস্থ চাঁদপুর সমিতি, ঢাকা, আজীবন সদস্য ইউনির্ভাসিটি উম্যান্স ফেডারেশেন কলেজ, ঢাকা সাবেক সদস্য, কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডি, ঢাকা, বিশেষ গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ভাষাসৈনিক শেখ মুজাফফর আলী ফাউন্ডেশনের চাঁদপুরের প্রধান উপদেষ্টাসহ বহু সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।

অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার লেঃ কর্নেল (অবঃ) মোঃ আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সনের ১লা জানুয়ারী চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানাধীন মদনেরগাঁও গ্রামের চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, মাতা মাজেদা বেগম ছিলেন হাজীগঞ্জ থানাধীন কাঁঠালি গ্রামের কাজী পরিবারের সন্তান। মোঃ আবু ওসমাস চৌধুরী চান্দ্রা ইমাম আলী হাইস্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ১ম বিভাগে মেট্রিক এবং ১৯৫৭ সালে গ্রেজুয়েশন শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মেজর রেঙ্কে উন্নীত হন। ১৯৬০ সনের ২৫ মার্চ মেজর ওসমান কুমিল্লা মৌলভী পাড়া মনসুর আহম্মেদ কন্যা নাজিয়া খানমের পাণি গ্রহন করেন। তাঁর দুই কন্যা নাজিয়া ওসমান ও ফাওজিয়া ওসমান । শৈশবের কিছুটা সময় রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলার রসুলপুর গ্রামে কাটে আবু ওসমান চৌধুরীর।

চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ মদনেরগাঁও ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা (১৯৪১-৪৪) ও মানিকরাজ জুনিয়র নিম্নমাধ্যমিক স্কুল (১৯৪৪-১৯৪৬), ফরিদগঞ্জ চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুলে এস.এস.সি (১৯৫১), ঢাকা কলেজ ১৯৫১-৫৩ সেশনে এইচ.এস.সি ও ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর সরকারী কলেজ, ১৯৫২ সনের একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ১৯৫৭ সালে স্নাতক পাশ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা এয়ারপোর্টে এয়ারপোর্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান ও প্রশিক্ষণ নেন । তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল (OTS) কোহাটে এবং ১৯৫৮ সালে ট্রেনিং ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ৫ সেপ্টেম্বর তিনি দুনিয়ার মায়া মমতা ছেড়ে পরকালে চলে যান।

-লেখক : আবু ওসমান চৌধুরীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চাঁদপুর।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন