আলহামদুলিল্লাহ : ফাইনালি ইটস নেগেটিভ!

ডা. হারুন-অর-রশিদ সাগর :
কে বললো করোনায় মানুষের মানবতা চলে গেছে! ভুল!! আমি তো দেখলাম মানুষের ভিন্ন রূপ। আজও ভালো মানুষের আধিক্যের কারণেই পৃথিবী টিকে আছে স্বমহিমায়। আমার স্ত্রী পরম মমতায় আমাকে ভালো করে তুললো। ওর মধ্যে কোন ভয় আমি দেখি নাই। ওর কিছু সিম্পটম থাকলেও ওকে স্যাম্পল দেওয়াতে রাজি করাতে পারিনি, বলে কিনা এন্টিবডি টেস্ট যখন করানো যাবে তখন করিয়ে নিবে।

আমি যে রুমে ছিলাম রুমের দরজাটা ওরা আমাকে একবারের জন্যও বন্ধ করতে দেয়নি। ডাইনিং টেবিলেই খাবার খেয়েছি আমি কখনো দূরতম চেয়ারে বসে, কখনো একটু আগে পরে করে। মেয়েটাকে একা আলাদা রুমে থাকতে হয়েছে, খাওয়া-দাওয়াও ওই রুমেই। নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে ওর নিজেকেই।

শেষ যেদিন চেম্বার এবং অপারেশন শেষ করে বাসায় আসি তার দুই দিন পর থেকে হঠাৎ সর্দি শুরু হলেই মনে হলো আমার গত ১৫/২০ বছরেও এটা হয়নি। এর একদিন পর জ্বর আসে, আমি আলাদা রুমে চলে যাই। এর মধ্যে ফাদার’স ডে চলে আসলো। আমার আলাদা রুমে থাকা মেয়ে না মানতে চাইলেও নিয়তি মেনে নিতেই হলো।

আমার মরহুম বাবাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখলাম সেদিন। পঞ্চম দিনে লুজ মোশান ও প্রচন্ড কানব্যথা, গলাব্যথা শুরু হলো। আমি ডা. রুবেলকে বললে ও আর ডা. পলিন ব্যবস্থা করলো স্যাম্পল নেওয়ার। দুইদিন পর সিভিল সার্জন ডা.সাখাওয়াত ভাই প্রথমে ম্যাসেজ এবং পরে ফোন দিয়ে জানান আমি করোনা পজিটিভ।

আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম তাই শংকিত হইনি। আমার দু’দুটো কো-মরবিডিটি থাকায় একটু চিন্তা যে মাথায় আসেনি তা নয়। চিকিৎসা আমি বাসায় নিয়েছি। আমার বাসা যেহেতু আমার হসপিটালের উপরেই তাই সাহস করে বাসায় থাকলাম। আল্লাহর রহমতে কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট কখনোই হয়নি। নিজের ইঞ্জেকশন নিজেই নিয়েছি, কারণ অন্য কাউকে ইনফেকটেড বানানোর কোন চান্স রাখিনি।

আমার শুভাকাঙ্ক্ষী চিকিৎসকদের (ডা. মুক্তা, ডা. শুভ, ডা. নাজমুল, ডা. সাইফ, ডা. সঞ্চিতা, ডা. সিরাজুম মুনির, ডা. জুয়েল, ডা. সোহেল, ডা. নোমানসহ আরো অনেকেই) অবিরাম খোঁজ নেওয়া কিংবা দু’এক জন শুভাকাঙ্ক্ষীর ম্যাসেঞ্জারে মজার মজার জোকস পাঠিয়ে মন ভালো রাখানোর চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর মধ্যে কয়েকজন নিজেরাও করোনা পজিটিভ।

এরা সবাই আমার চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ আর মনস্তাত্ত্বিক সাহস প্রদান করলেও এর মধ্যে ডা. সাইফ আর ডা. সঞ্চিতা আমার স্ত্রীকে প্রবলভাবে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে অবিরাম। ইতিমধ্যে অতিক্রম করা তিনটি শুক্রবারেই মসজিদে মসজিদে মিলাদের আয়োজন করেছেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা। অনেকে আবার তাদের বাড়িতেও মিলাদের আয়োজন করেছেন।

ইনবক্সে কেউ যখন বলে যে ভাই আপনার সাথে ওভাবে পরিচয় নেই কিন্তু আমি আপনার জন্য তিনটা রোজা রাখছি; তখন চোখ কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভিজে যায়। আরো অনেকেই রোজা রেখেছেন। যার যার মতো করে অনেকেই দোয়া করেছেন, খবর নিয়েছেন। আপনাদের পাঠানো একেকটা ম্যাসেজ একটা টনিক হিসেবে কাজ করেছে, সাহস রাখতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।

কারো নাম উল্লেখ না করলেও প্রায় প্রতিদিন খবর নিয়েছেন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ও সহযোদ্ধাগণ। কিন্তু দু’একজনের নাম না বললে অন্যায় হবে। বলছিলাম স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী ম্যাডামের কথা, প্রায় প্রতিদিন খবর নিয়েছেন উনি। খোকা ভাই, আমাদের মহিউদ্দিন খোকা ভাই প্রায় প্রতিদিন, কোন দিন তিন-চার বার খবর নিয়েছেন।

আমার আম্মাসহ আত্মীয়-স্বজনদের ফোন কান্নার উদ্রেক ঘটালেও কষ্ট করে চেপে যেতে হয়েছে বারংবার। বোনরাসহ অনেকেই সিমুকে ফোন দিয়ে সবকিছুর খবর নিয়েছেন বারবার। আমার শাশুড়ীর দুই মেয়ের জামাই করোনা পজিটিভ, উনার নিজের অসুস্থতার জন্য উনাকে জানানোই হয়নি।

উনার সাথে এর মধ্যে আমি ফোন করে গল্প করেছি, উনাকে বুঝতেই দেইনি। ছেলেকে ভিডিও কলে অন্যদিকে ফিরে কান্না লুকাতে দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠছিলো। ও না বুঝেই ওখান থেকে চলে আসতে চেয়েছিলো; ও ভুলেই গিয়েছিল সিডনি-ঢাকা ফ্লাইট বন্ধ আছে।

মানুষের ভালোবাসার বিভিন্ন রকম বহিঃপ্রকাশ দেখে কান্না করেছি নিজের অজান্তেই বহুবার। বাড়ি থেকে টেংরা মাছ আর শিং মাছ ধরে কেটে নিয়ে আসছে আত্মার আত্মীয় এক ছোট ভাই। কুমিল্লার রস মালাই বোগদাদের কাউন্টারে এসে ড্রাইভারকে রিকোয়েস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছে এত্ত বড় হৃদয়ের অধিকারী এক বন্ধু, ফরিদগঞ্জের আউয়ালের মিষ্টিও নিয়ে আসছে কয়েকজন সুহৃদ।

ভাগ্নী ঢাকা থেকে কেএফসি’র বার্গার আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে এসেছে। খোলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমাকে অপলক দেখে, ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্ট নিয়ে চলে গেছেন আম্মা, বড় বোনরা, ভাগ্নী, কয়েকজন কাছের ছোট ভাই। আম্মা বলে উঠলো- ‘আর কদিনই বা বাঁচবো, তাও আমি ধরবো তোরে’। আমি বহুকষ্টে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। একজন তো কোন বাধা না শুনে আমার রুমেই ঢুকে গিয়েছিলো! রসুইঘর আর রেড চিলি বাসায় প্রিয় থাই স্যুপ আর অন্যান্য খাবার পাঠিয়ে চমকে দিয়েছে।

প্রথম স্যাম্পেলর ১৪ দিন আর লক্ষ্মণ প্রকাশের ১৯ দিনের মাথায় দেওয়া দ্বিতীয় স্যাম্পেলর রিপোর্টও পজিটিভ আসায় হতাশ হলেও কারণটা বুঝতে পারায়

ভেংগে পড়িনি। কারণ আমার লক্ষ্মণ ছিলো না এর প্রায় ৮-১০ দিন আগে থেকেই। কিন্তু অনেক সময় ডেড ভাইরাস শো করলেও আরটি-পিসিআর মেশিন পজিটিভ দেখাবে। এরপর কাংখিতভাবেই তৃতীয় রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো। এ রিপোর্টটা আমি ঢাকায় করিয়েছি। আমি, আমরা সবাই খুশি। চিরচেনা পরিবেশ আমাকে ডাকছে। রোগী, সেবা এগুলো চলবে অবিরাম।

আমার তিন বোন। এরা সবাই আমার বড়। আমার ছোট আপা আমার সাথে দেখা করতে আসতে চাইলো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। আমি বললাম না, আমি চাঁদপুর যাওয়ার পথে দেখা করবো। দেখা হলে সে এক অন্য পরিবেশের অবতারণা হলো। ততক্ষণে তো আমি নেগেটিভ। আল্লাহ তোকে নতুন জীবন দিলো বলে আপার কান্না, আমি সারাপথ কান্নার রেশ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। এই যে প্রায় শ’খানেক চিকিৎসক জীবন দিয়ে কারো ব্যর্থতার বলি হলেন সেখানে আমিও যুক্ত হতে পারতাম।

আমার অসুস্থতার মাঝেই আমি অনেককেই ম্যাসেঞ্জারে, ফোনে চিকিৎসা বিষয়ক পরামর্শ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এতো ইতিবাচক ঘটনার মধ্যে একটা অমানুষের টিজিং এর শিকার আমিও হয়েছি। অজস্র ভালো মানুষের ভীড়ে ওকে আসলে মানুষ হিসেবেই গণনা করা উচিৎ নয়।

এই যে বেঁচে থাকা, আল্লাহর দয়ায় আর আপনাদের দোয়ায়। আপনাদের ভালোবাসার প্রতিদান আমার ক্ষুদ্র জীবনে কিভাবে দিবো জানিনা! তবে এটুকু বলতে
পারি, এখন আমি নিশ্চিন্তে অকাতরে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে পারবো নিজেকে, বিলীন করে দিতে পারবো আগপাছ না ভেবেই।

দিনশেষে ভালোবাসার’ই জয় হয়। আপনাদের ভালোবাসার শক্তিতে আর আল্লাহর রহমতে আমি সুস্থ হয়েছি এ যাত্রায়। স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরবো শীঘ্রই ইনশাআল্লাহ।বিশেষ ধন্যবাদ সিভিল সার্জন, চাঁদপুর ডা. সাখাওয়াত ভাই, ছোটভাই ডা. রুবেল ও ডা. পলিনকে স্যাম্পল দিতে স্পেশাল সহযোগিতার জন্য।

কথা হবে, দেখা হবে বন্ধু, কারণে কিংবা অকারণে….

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)