করোনার ৪৮ ঝুঁকিপূর্ণ জেলার মধ্যে চাঁদপুর : লকডাউন নিয়ে আলোচনা!

নিজস্ব প্রতিবেদক :
চাঁদপুর জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা রোববার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অসীম কুমার বণিকের পরিচালনায় এই সভায় স্বাগত বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, চাঁদপুরের করোনা পরিস্থিতি এখনো উন্নতি হয়নি বরং জেলাটি ৪৮টি ঝুঁকিপূর্ণ জেলার মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর। তারপরও মানুষ মাস্ক পড়া নিয়ে শৈথল্য শুরু করেছে। হাট-বাজার, সড়কে যাত্রী, চালক, অফিস, আদালতেও আগের মতো মাস্ক পড়া নিয়ে কোনো সচেতনতা বা মাস্ক পড়তে দেখা যাচ্ছে না। অথচ করোনার এই ভয়াবহতা রোধে মাস্ক অন্যতম উপাদান।

তিনি বলেন, আমাদের চারপাশের কয়েকটি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পূর্ণ লকডাউন চলছে এবং লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। আমরা চাই না চাঁদপুরে লকডাউন ঘোষণা করা হোক। চাঁদপুরে লকডাউন ঘোষণা করতে যেন না হয়, সে জন্য সবাই সচেতন হউন, মাস্ক পড়ুন।

জেলা প্রশাসক বলেন, লকডাউন ঘোষণা করা ত্বরিৎ বিষয় মাত্র। কিন্তু এই লকডাউন যে কতটা ভয়াবহ ক্ষতি আনতে পারে মানুষের জীবন-জীবিকায় তা নতুন করে বলার কিছুই নাই। তাই তিনি জেলাবাসীকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান, আপনাদের ভালোর জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, জীবন-জীবিকা সচল রাখার জন্য আপনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক পড়–ন।
তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় আছে। এখন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম কঠোর করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় গণপরিবহণ মালিকরা দৃষ্টি দেবেন শ্রমিকরা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। এছাড়া দোকান-পাট, শপিং মলের মালিক শ্রমিকরা আমাদের কথা দিয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। কিন্তু তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, আপনারা যদি সবাই সজাগ থাকেন, প্রশাসনের সাথে জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত থাকলে করোনার প্রার্দুভাব বা সংক্রমণ হ্রাস করা চাঁদপুর জেলায় অসম্ভব কিছু না। জেলা প্রশাসক ষ্পষ্টত বলেন, যে যার দায়িত্বে আছেন, যেখানেই আছেন, সেখান থেকেই নিজে সচেতন হয়ে অন্যকে সচেতন করতে হবে, সচেতনতা মূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখবেন, জেলা যদি লকডাউন হয়ে অচল হয়ে যায়। তাহলে এর ক্ষতিটা অনেক, সেই পথে আমরা এগুতে চাই না। কিন্তু আপনাদের আমাদের ভুলের কারণে বা অসেচতনার কারণে যদি তা হয়, তাহলে করার কিছু থাকবে না। তাই এখনই সতর্কতা অবলম্বন করুন। তিনি বলেন, চাঁদপুর জেলায় করোনায় আক্রান্তের হার ১৩ ভাগ থেকে ২৮ ভাগে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রকম বৃদ্ধি হতে থাকলে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে তিনি বলেন, গত মাসের চেয়ে এ মাসের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলণামূলক ভালো। তবে এই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় আরো সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এজন্য সবাইকেই বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিসহ সুধী সমাজকে ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, অবৈধ ড্রেজার, অবৈধ গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করে যাচ্ছেন। অবৈধ ড্রেজার আটকের পর ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু এর নেপথ্যে কারা কাজ করছে, তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায়না। তিনি বলেন অবৈধভাবে কেউ মাটি, বালি উত্তোলন করে প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা। প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছে।

পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ বিপিএম (বার) বলেন, সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে কিংবা করোনা মোকাবেলায় পুলিশ ও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব না। তিনি মাদক আসক্তি ও মাদক ব্যবসা বিষয়ে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। মাদক কারবারি বা মাদকসেবীদের আটক করা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অন্তত দুঃখের বিষয় এই মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবীরা আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে বেড়িয়ে এসে আবার পূর্বের ন্যায় মাদক ব্যবসা বা সেবন শুরু করে। এমনও দেখা গেছে, একজনের বিরুদ্ধে মাদকের ১৪টি মামলা আছে, তার পরের মামলায় তাকে ধরা হলেও আবার কয়েকদিন পর সেও ছাড়া পাচ্ছে। ফলে মাদকাসক্ত বা ব্যবসায়ী সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সুপার বলেন, কোন অপরাধ সংঘটিত হলে অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী পাওয়া যায়না বা সাক্ষী দিতে আসে না। ফলে অনেক কঠিন মামলাও হালকা হয়ে যায়। তিনি এক্ষেত্রে সরকারি আইনজীবী বা অন্যান্য আইনজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনারা এই বিষয়গুলিকে কঠিনভাবে দেখুন। পুলিশের হাতে কোন বিচারিক ক্ষমতা নেই। তাই পুলিশ বিচারিক কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনা। অতএব, আদালত ও আইনজীবীগণ যদি এই বিষয়ে তথা মাদক বিষয়ে যদি আরো একটু কঠোর হন, তাহলে এ ধরণের অপরাধ অনেকটা কমে যাবে, আমাদের জন্য সুবিধা হবে। এতে অপরাধীরাও ভীতসন্ত্রস্ত হবে। পুলিশ সুপার আরো বলেন, আমার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যদি কেউ অপরাধ করে থাকে বা অপরাধ করে আমরা তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, একদিনেই পরীক্ষার হার অনুযায়ী ১৩ ভাগ থেকে ২৮ ভাগে আক্রান্ত হারে বেড়ে গেছে। এতে বুঝা যায়, করোনার ভয়াবহতা বাড়ছে। মানুষকে সচেতন হওয়া জরুরী।

চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মোঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল তার বক্তব্যে বলেন, বড়স্টেশন মোলহেডে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্যে জেলা প্রশাসনের সাথে চাঁদপুর পৌরসভা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের এখানে সমর্থন রয়েছে। বিশেষ করে চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর বড়স্টেশন মোলহেড এলাকায় একটি সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। গতকাল পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান উক্ত জায়গা পরিদর্শন করেছেন। আমরাও কয়েকবার এটি পরিদর্শন করেছি। একটি চলাচলের রাস্তা বের হয়েছে। আমাদের স্পষ্ট কথা, রেলওয়ে তার লাইন আর পশ্চিম দিকে বর্ধিত করা কোনভাবেই উচিত হবেনা। আর জনগণও সেটা চায়না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও আমাদের সহযোগিতা করবে বলে আশা করছি। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্ব জোন থেকে ঐতিহ্যবাহী মাছঘাটের যাওয়ার রাস্তাটি দেয়াল করে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যা কখনোই করা উচিত না। এই ঐতিহ্যবাহী মাছঘাট এবং তৎসংলগ্ন স্থান দিয়ে আমাদের একটি সড়ক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি রেলওয়ের এধরণের পদক্ষেপের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বড়স্টেশন মোল হেড অনেক আগে থেকেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষের আকর্ষণীয় স্থান। সেটাকে সুন্দর করার জন্য চাঁদপুর পৌরসভা থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে দেয়া হয়েছিল। এখানে পর্যটন কেন্দ্র ছাড়া অন্য কিছু করা ঠিক হবে না। তিনি বিষয়টি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এখানে রেলওয়ের স্থাপনা করাটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, যে রেল স্টেশনটি বড় স্টেশনে রয়েছে, তা আরো পূর্ব দিকে সরিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। কারণ রেলেরে জমির অভাব নেই। স্টেশনটি পূর্ব দিকে সরিয়ে আনলে সেখানে আরো বড় আকারের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যাবে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল তার বক্তব্যে বলেন, বড়স্টেশন মোলহেড সত্যিকার অর্থেই একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এটাকে আরো আকষর্ণীয় করা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে আমাদেরকেও জানানো উচিত।

বড়স্টেশন মোলহড সম্পর্কে জেলা প্রশাসক বলেন, শনিবার পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান বড়স্টেশন মোলহেডটি পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি এটি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও মুগ্ধ হয়েছেন। সেখান জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় জনগণও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে গেছেন, এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হবে।

ফরিদগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবুল খায়ের পাটওয়ারী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডেল কেরোয়া এলাকায় একটি বাল্যবিয়ের ঘটনা উল্লেখ্য করে বলেন, সেখানে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার পর সেই বাড়ির অবস্থানকারী পৌরসভার কাউন্সিলর ও পাশের বাড়ির আবুল হাসেমকে মেয়ে পক্ষ মারধর করে। বর্তমানে তারা চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে থানার অফিসার ইনচার্জকে জানালে তিনি দরখাস্ত দিতে বলেন। মামলা হওয়ার পর চার দিন অতিবাহিত হলেও আসামীরা গ্রেফতার হচ্ছে না। এখানে ওসির চরম গাফিলতির অভিযোগ করেন। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন।

চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী তার বক্তব্যে বলেন, এক সময়ের দানব ট্রাক্টর আবার গ্রামে অলিতে গলিতে এমনকি শহরে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মতলব উত্তর ও দক্ষিণ এলাকায় এসব চলাচল করছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, আবার আমাদের এই জেলা লকডাউনে পড়–ক তা আমরা চাই না। তাই সকলকে সচেতন হয়ে স্বাস্থ্য্যবিধি মেনে চলতে হবে।

সভায় আরো বক্তব্য রাখেন এনএসআইয়ের ডিডি, বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ, পিপি অ্যাড. রনজিত রায় চৌধুরী, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. আহসান হাবীব, ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলী হরি প্রমুখ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন