চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ গেল কই!

তালহা জুবায়ের :
ভরা মৌসুমেও জেলেরা নাগাল পাচ্ছে না ইলিশের। কালেভদ্রে যা জালে উঠছে, তা দিয়ে নৌকার খরচের টাকাই তোলা দায় হয়ে পড়ছে। সংসারের চাকা আর ঘুরছেনা জেলেদের। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ইলিশ সংকটে শুধু জেলেদের নয়, প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যতম বড় ইলিশের বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছ ঘাটেও।

মৎস্য ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে এখন ফতুর হওয়ার অবস্থায়। বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে যেখানে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মণ ইলিশ আহরণ হতো, বর্তমানে তা হচ্ছে মাত্র ৫শ’ থকে ৬শ’ মণ। চাহিদার তুলনায় ইলিশের যোগান কম থাকায় দামও অনেক বেশী।

গত বছর মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ অভিযান সফল না হওয়া, নদী দূষণ, নাব্যতা সংকট, অপরিকল্পিত ড্রেজিং ও নদীর তলদেশে থাকা ডুবো চর এবং ইলিশের গতি পথ বদলের কারণে স্থানীয় পদ্মা-মেঘনায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।

তবে ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এ বছর ইলিশ জেলেদের জালে কিছুটা দেড়িতে ধরা পড়ছে। তবে ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে পৌনে ৬ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ মেট্রিক টনে পৌঁছাবে বলে আশাবাদী তারা। অচিরেই জেলেরা কাঙ্খিত ইলিশ পাবে বলে হতাশ হতে বারণ করছেন ইলিশ গবেষকরা।

গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন বড়স্টেশন মাছ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা বিক্রেতাদের উপড়েপড়া ভিড়। সেই তুলনায় মাছের আমদানী অনেক কম। দুপুর দেড়টা না বাজতেই অধিকাংশ ব্যবসায়ীর আড়তে ফুঁড়িয়ে গেছে ইলিশ।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার বলেন, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু সেই তুলনায় পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ নেই বললেই চলে। সাগরে কিছু মাছ ধরা পড়ায় এই বাজারে মাছ আসছে।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছর আগেও পদ্মা-মেঘনা নদীতে জেলেরা প্রচুর পরিমানে ইলিশ পেত। কিন্তু দিন দিন এই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। আগে মৌসুমে স্থানীয় নদীতে প্রতিদিন জেলেরা ১ হাজার থেকে ১২শ’ মণ ইলিশ আহরণ করলেও বর্তমানে তা ২০-৩০ মণও হয় না। নদীতে ইলিশ না পাওয়ায় জেলেদের অনেক কষ্টে দিন কাটছে।

তিনি বলেন, ঘাটে আমাদের যেই বিনিয়োগ, সেই পরিমানে মাছ এই বছর আসে নাই। আগামী দেড় থেকে দুই মাস পড়ে আসছে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান। এই সময়টাতে ইলিশের সরবরাহ যদি বৃদ্ধি পায়, তবে আমাদের ক্ষতি কিছুটা পুসিয়ে ওঠা যাবে। নয়তো লোকসানে পড়বে অনেক ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, বর্তমানে এই সময়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ মণ মাছ ঘাটে আসছে, যার সিংহভাগই সাগর ও সাগর মোহনা অঞ্চলের মাছ। বর্তমানে হাতিয়া, সন্দিপ, নোয়াখালী, আলেকজান্ডার ও রামগতি এলাকা থেকে বেশির ভাগ মাছ এই ঘাটে আসছে। যা রাজধানী ঢাকা, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, নাটোর, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবে বরাত বলেন, মূলত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু এবছর আগস্ট মাসের অর্ধেক শেষ হয়ে গেলেও বাজারে মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়নি। বিগত বছরগুলোতে মৌসুমে ইলিশের আমদানী ৫ হাজার মণ থেকে ১০ হাজার মণ পর্যন্ত হতো। আমরা ভোর সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ বেঁচা-কেনা করতাম। কথা বলাম ফুৎসরত পেতাম না। কিন্তু এখন ঘাটে ঠিকমত ৫শ’ মণ ইলিশও সরবরাহ হচ্ছে না। আগে বড় ব্যবসায়ীরাই দিকে ৪শ’-৫শ’ মণ ইলিশ বিক্রি করতো। ইলিশ না থাকায় এখন ২টা না বাজতেই ইলিশ শূণ্য হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের আড়ৎগুলো।

তিনি বলেন, দেশব্যাপী চাঁদপুরের ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ইলিশের সরবরাহের তুলনায় চাদিহা অনেক বেশি থাকায় দাম বেশি যাচ্ছে। বর্তমানে ১ কেজি থেকে ১ কেজি ৪শ’ গ্রাম ওজনের মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি সাড়ে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ১ হাজার টাকা কেজি দরে। ৭শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম ওজনের মাছ কেজি প্রতি ১ হাজার টাকায়, যা গত বছর সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় এবং ৪শ’ থেকে ৬শ’ গ্রাম ওজনের মাছ কেজি প্রতি ৭শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা কেজি দরে।

তিনি আরো বলেন, মূলত গত মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা সংরক্ষণ অভিযানের সময় করোনা থাকায় প্রশাসনের লোকজন উপরে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে অসাধু জেলেরা নদীতে ব্যাপক হারে ইলিশ ও জাটকা নিধন করেছে। তাছাড়া সারা বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে নদীতে ড্রেজিং, নদী দূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইলিশ নদী বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাই হয়তো মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। তবে এভাবে চলতে থাকলে জেলে বা ব্যবসায়ী কেউই টিকে থাকতে পারবে না এই পেশায়।

চাঁদপুর সদর উপজেলার হরিণা ফেরিঘাট এলাকার জেলে আলী আকবর বলেন, ‘মার্চ-এপ্রিল দুই মাস জাটকা অভিযানের শেষে ১ মে তনে গাঙ্গ ইলিশ দরতে নামচি। কিন্তু গাঙ্গ মাছ নাই। যেই মাছ পাই হেইডা দিয়া ঠিকমত নৌকার খরচই ওডে না। আমাগো বাল-বাচ্চাগো লইয়া কেমনে সংসার চালামু? মাছ না পায়া অনেকেই অহন রিক্সা চালায়, হকারি করে, দিন দিন জালের কাম করাই কটিন অইয়া যাইতাচে।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, আগস্টের শুরু থেকে সাগর ও সাগর উপকূলের জেলাগুলোতে ইলিশ পাওয়া শুরু করেছে জেলেরা। আশা করি অচিরেই চাঁদপুরের জেলেরাও পর্যাপ্ত ইলিশ পাবে। কারন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাস ইলিশের মূল মৌসুম।

তিনি বলেন, পদ্মা-মেঘনার পানি দূষণের পাশাপাশি নদীতে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবো চর থাকায় ইলিশের চলাচলের পথ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও আগের তুলনায় ইলিশ নদীতে আসছে কম। অচিরেই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। আমরা আশাবাদী ইলিশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে গত বছরের উৎপাদন সাড়ে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে এ বছর ইলিশের উৎপাদন পৌঁনে ৬ লক্ষ থেকে ৬লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নিত হবে।

তিনি আরো বলেন, পদ্মা-মেঘনা নদী মিলিত হয়ে সাগরে নেমেছে। নদীর সেই রুটটায় বেশ কিছু চর, ডুবোচরের কারণে বর্তমানে নদীর নাব্যতায় সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে ইলিশ নদীতে আসতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে তাই বলে সম্পূর্ণ জায়গা বদল করে ইলিশ ভারতে চলে যেতে চাচ্ছে বা যাচ্ছে এমন কোন তথ্য আমাদের গবেষণায় ধরা পড়েনি এখনো। তবে একটু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন