চাঁদপুরে করোনাযুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধারা অবহেলিত

রহিম বাদশা :
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় সন্দেহভাজন ও শনাক্তকৃত রোগীদের এড়িয়ে চলছেন প্রায় সকলেই। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-সহকর্মী এমনকি কোনো কোনো চিকিৎসক পর্যন্ত তাদের থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়েও করোনার সন্দেহভাজন ও শনাক্তকৃত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মী। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে নিত্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছেন তারা। স্বাস্থ্য বিভাগের নিচের দিকের কর্মচারী হয়েও মানবতার সেবার সর্বোচ্চ শিখড়ে নিজেদের তুলে ধরেছেন তারা। এই বীর করোনাযোদ্ধাদের পদবী মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। তাদের সঙ্গী ইপিআই’র স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এরাই প্রতিদিন করোনার সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত অথবা করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তকৃত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে থাকেন। করোনা টেস্টের প্রথম ও সর্বাধিক ঝুঁকির কাজটি করে চলেছেন তারা। সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা পরীক্ষা যতটা ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্তকৃত রোগীর নমুনা সংগ্রহ আরো বেশি ঝুঁকির বিষয়। কারণ, নমুনা পরীক্ষা করার জন্য রোগীর খুব কাছে যেতে হয় তাদের। কেবল কাছেই নয়, রোগীর মুখে ভাইরাস জমে থাকা অতি স্পর্শকাতর স্থান থেকে ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করতে হয় এসব মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টকে।

ঝুঁকি ও ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, সতর্কতা ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও নমুনা সংগ্রহ করা টেকনোলজিস্টরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এমনি একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার পর এখন অবশ্য সুস্থ হয়েছেন তিনি।

তারপরও মানবসেবার ব্রত নিয়ে করোনা মহামারীতে চাঁদপুরসহ সারাদেশে ল্যাব টেকনোলজিস্টরা নমুনা সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভয় যে তাদের মধ্যে নেই, তাও নয়! তবুও কখনো চাকুরির মায়া, কখনো সরকারি নির্দেশনা আবার কখনোবা নিখাঁদ মানসেবার ব্রত নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

দু’-চারজন ভয়ে পালিয়ে যাওয়া বা আত্মগোপনের ঘটনাও ঘটেছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতা ও আন্তরিকতায় সবাই কাজের মধ্যে আছেন এখন। যেমন মতলব উত্তরে চিকিৎসকসহ ৩জন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ভয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে কিছু সময়ের জন্য আত্মগোপন করেছিলেন। তখন সিভিল সার্জন অফিস থেকে বিশেষ টিম যেয়েও সেখানকার সন্দেহভাজনদের নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে। কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে সেই টেকনোলজিস্ট অবশ্য আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।

টেকনোলজিস্টদের পাশাপাশি চিকিৎসকরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে সর্বত্রই এ জন্য চিকিৎসকরা সম্মানিত, আলোচিত ও বীরোচিত বিশেষণে প্রশংসিত হচ্ছেন। কিন্তু সে তুলনায় অধিক ঝুঁকি নিয়েও অনেকটাই আড়ালে রয়ে যাচ্ছে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন বাজি রাখা নমুনা সংগ্রহের কাজ। অনেক ক্ষেত্রেই তারা অবহেলিত, বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। তারা যথাযথ সুরক্ষা, নিরাপত্তা, প্রণোদন ও সম্মান পাচ্ছেন না। তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এম-৯৫ মাস্ক থেকেও বঞ্চিত তারা।

এসব মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট তথা স্বাস্থ্যকর্মী সাধারণত সরকারি হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সন্দেহভাজন/শনাক্তকৃত রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে থাকেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে লোকজনের বাসা/বাড়িতে যেয়েও নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। আবার কেউ উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেও তার নমুনা সংগ্রহ করতে হয় অকুস্থলে যেয়ে। রাত-বিরাতেও এ কাজ করতে হয় জরুরী ক্ষেত্রে।

চাঁদপুর সদর হাসপাতাল ও জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (সদর উপজেলার পৃথক হাসপাতাল নেই) করোনা পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহ করতে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বা কেউ মারা গেলেই ছুটে যাচ্ছেন নমুনা সংগ্রহ করতে। পরিবারের কথা না ভেবে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এসব করোনাযোদ্ধা।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালে বিভিন্ন বিভাগের ৭জন মেডিক্যাল টেকনোলোজিস্ট দায়িত্ব পালন করছেন করোনার উপসর্গ থাকা ব্যক্তির/শনাক্তকৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহে। তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা আতঙ্কে থাকলেও দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তারা। তাদের জন্য প্রদানকৃত সুরক্ষা সামগ্রীগুলো কতটুকু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক টেকনোলজিস্ট বলেন, ভয়ে থাকি, তারপরও দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবারও আতঙ্কিত তবে অসম্মতি জানায়নি দায়িত্ব পালনে। শুক্রবার (৮ মে) পর্যন্ত ১৭৬জনের নমুনা সংগ্রহ করেছি আমরা। পাশাপাশি সিডিউল ডিউটিও করতে হচ্ছে। নমুনা সংগ্রহের পর বাসায় ফিরে সাবান দিয়ে গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হই। ভয়ে আছি, তবুও পিছু হটলে চলবে না যে!

তিনি আরো জানান, পিপিই পড়লেও মাঝে মাঝে ভয় হয় এটি কতটুকু সুরক্ষা দেবে- এই ভেবে। তাছাড়া আমাদের জন্য এম-৯৫ মাক্স খুব দরকার। কিন্তু সরবরাহ না থাকায় বিকল্প হিসেবে একসাথে ৩টি করে মাক্স ব্যবহার করি। ভয় লাগে। কি করবো? সব আল্লাহ’র উপর ছেড়ে দিয়েছি।

চাঁদপুর সদর হাসপাতালের আরএমও, করোনা বিষয়ক মেডিক্যাল টিমের প্রধান ও ফোকালপার্সন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, আমাদের হাসপাতালের ৭জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট জীবনেরে মায়া ত্যাগ করে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে চলেছেন। তাদের উপযুক্ত প্রণোদনা, নিরাপত্তা, ঝুঁকিভাতা ও সম্মানিত করা দরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমি তো চিন্তা করছি, আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর আমি নিজেও তাদের সম্মানিত করবো আমার অবস্থান থেকে। তিনি বলেন, আমার খুব দুঃখ লাগে এত ঝুঁকি নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদেরও অনেকে অবহেলা করছেন। এমনকিও কোনো কোনো ডাক্তারও তাদের এড়িয়ে চলছেন, কথা পর্যন্ত বলছেন না তাদের সাথে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতেও নমুনা সংগ্রহের জন্য গঠন করা হয়েছে একটি করে মেডিকেল টিম। চাঁদপুর সদর উপজেলায় হাসপাতাল না থাকলেও এমন একটি টিম আছে এবং কাজ করছে। সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন বলেন, আমাদের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট না থাকলেও যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে একজন টেকনোলজিস্ট এনে কাজ করা হচ্ছে। আমাদের ইপিআই স্বাস্থ্যকর্মীকে এ টিমে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার মতে সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এসব মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। ডাক্তারদের চেয়েও বেশি ঝুঁকি তাদের। তাই এখন কিংবা পরে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয়ভাবে সম্মানিত করা দরকার।

উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত আরেকজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, সরকারি চাকরি করি, তাছাড়া মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতাও রয়েছে। জাতীয় এ দুর্যোগের সময় মানুষের জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। ভয় তো আছেই। কি করবো। কাজ করতে করতেই হবে। সতর্কতা অবলম্বন করেই নমুনা সংগ্রহ করে যাচ্ছি।

এভাবেই জেলার ৮টি উপজেলায় স্বাস্থ্যকর্মীরা একযোগে মাঠে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন। চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস থেকে জানা যায়, শুক্রবার পর্যন্ত চাঁদপুর থেকে ৭০০জনের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়া গেছে ৫৪২জনের। এর মধ্যে মৃত ৪জনসহ ৩২জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। যদিও জেলায় বর্তমানে রোগীর সংখ্যা ৩৪জন। বাকী ২জন অন্যত্র শনাক্ত হয়ে এখানে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

নমুনা সংগ্রহকারী এসব স্বাস্থ্যকর্মীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করার কাজ করছেন। ৮টি উপজেলায় একটি করে করোনা পরীক্ষায় নমুনা সংগ্রহকারী টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি চাঁদপুর সদর হাসপাতালে সবচেয়ে বড় একটি টিম রয়েছে। তাদের মাঝে পর্যাপ্ত পিপিই, মাক্স, গ্লাভস ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়েছে। তারা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে কাজটি করছেন। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার। আমরা তাদের উৎসাহিত করে যাচ্ছি। তারা ভয়ের মধ্যেও কাজ করছে।

তিনি বলেন, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের কয়েক দফা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে নমুনা সংগ্রহের জন্য। তাছাড়া তাদের হামের নমুনা সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আছে বলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি আরো বলেন, সরকার আলাদাভাবে নমুনা সংগ্রহকারীদের নামের তালিকা নিয়েছে। ৮টি উপজেলা ও জেলা সদর হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহকারীদের তালিকা আমি পাঠিয়েছি। তাদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া উচিত।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন