চাঁদপুরে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা সদরেই সীমাবদ্ধ!

রহিম বাদশা :
চাঁদপুর জেলায় কার্যত জেলা সদর হাসপাতাল ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে সীমাবদ্ধ রয়েছে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্তে নমুনা সংগ্রহ, আইসোলেশন, চিকিৎসা, সচেতনতা, টিকা প্রদান, লকডাউন বাস্তবায়নসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম। নমুনা সংগ্রহ, আক্রান্ত শনাক্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে ভর্তির তথ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সারা জেলায় এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যত রোগী শনাক্ত হয়েছেন তার অর্ধেকেরও বেশি সদর উপজেলার। অন্যদিকে সারা জেলায় যতজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সদর উপজেলায় সংগৃহীত। জেলা সদর হাসপাতালের ৬০ শয্যার করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে যখন বেডের চেয়ে বেশি রোগী তখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ওয়ার্ডের বেড খালি পড়ে আছে। অধিকাংশ উপজেলায় করোনার কোনো রোগী’ই হাসপাতালে চিকিসাধীন নেই।

চাঁদপুর সদর উপজেলায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি জেনারেল (জেলা সদর) হাসপাতালটি অবস্থিত। এই হাসপাতালে জেলার একমাত্র করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড অবস্থিত। ৬০ শয্যাবিশিষ্ট ওই আইসোলেশন ওয়ার্ডে করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত শনিবার এই ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬২জন।

অথচ জেলার বাকী ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত করোনা রোগীদের কার্যত কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাঝেমধ্যে ১-২জন রোগী ভর্তি করা হয়। করোনা ওয়ার্ড ঘোষণা দিয়ে কিছু বেড সংরক্ষিত করে রাখা হলেও সেখানে রোগী ভর্তি নেই। করোনায় আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ থাকা রোগী পেলেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতালে। এতে সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা হিমশিম খেলেও আরাম-আয়েশে সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন উপজেলার চিকিৎসকরা। করোনা শনাক্ত ও চিকিৎসার এই বৈষম্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রামের গরীব-অসহায় মানুষ। তাদের অনেকের পক্ষে জেলা সদরে এসে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয় না।

কচুয়া উপজেলার রহিমানগর এলাকার আ. খালেক (৫৫) জানান, পরপর ২ দিন উপজেলা হাসপাতালে যেয়েও তিনি তার আত্মীয়ের নমুনা দিতে পারেননি। পরে বাধ্য হয়ে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিয়েছেন। আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। তার অভিযোগ, উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।

ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা এলাকার আবুল হোসেন (৬৫) জানান, উপজেলা হাসপাতালে প্রতিদিন নমুনা নেওয়া হয় না। সেখানে গিয়ে নমুনা দিতে না পেরে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নমুনা দিয়েছেন তিনি। জেলা সদরে যেয়ে নমুনা দিতে অনেক সময় ও পরিবহন খরচ লাগে বলে বেশি অসুস্থ না হলে অনেকেই জেলায় নমুনা দিতে চায় না বলে জানান তিনি।

সিভিল সার্জন অফিসের ৩ জুলাই’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলায় এ পর্যন্ত ৩২ হাজার ৫৮২জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলা ও সদর হাসপাতাল মিলে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৪৬৪। বাকী ৯ হাজার ১১৮টি নমুনা সংগ্রহ হয়েছে জেলার ৭টি উপজেলা থেকে। সবচেয়ে কম ৭৮১টি নমুনা সংগ্রহ হয়েছে কচুয়া উপজেলা থেকে। নমুনা সংগ্রহের এই চিত্রে স্পষ্ট চাঁদপুর সদর ব্যতিত অন্যান্য উপজেলায় করোনার নমুনা সংগ্রহে কতটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন সেখানের চিকিৎসা কর্মকর্তারা।

সিভিল সার্জন অফিসের সর্বশেষ হিসেব অনুুযায়ী, জেলায় এ পর্যন্ত (৩ জুলাই) ৫ হাজার ৬০৮জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলায় শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬৪৭জন। যা জেলায় মোট আক্রান্তের অর্ধেকের চেয়েও বেশি। সবচেয়ে কম ১৮৮জন রোগী শনাক্ত হয়েছে কচুয়ায়। সেখানে নমুনা সংগ্রহও সর্বনিম্ন। এই পরিসংখ্যানে বুঝা যায়, নমুনা সংগ্রহ কম হওয়ায় শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছেন আরো অনেকে।

এছাড়া চাঁদপুর জেলায় করোনার নমুনা সংগ্রহ ও আক্রান্ত উপজেলার উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, হাইমচরে ৯৭৪জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৭৫জন, মতলব উত্তরে ১৩৪৩জনের মধ্যে ৩১৫জন, মতলব দক্ষিণে ১০৮২জনের মধ্যে ৪৯৯জন, ফরিদগঞ্জে ১৩৩৭জনের মধ্যে ৬২৫জন, হাজীগঞ্জে ১৩৫৮জনের মধ্যে ৫৬৩, শাহরাস্তিতে ২২৪৩জনের মধ্যে ৪৯৬জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

অন্যদিকে জেলায় এখন পর্যন্ত করোনায় ১২৭জনের করোনায় মৃত্যুর তথ্য রয়েছে সিভিল সার্জন অফিসে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৯জন চাঁদপুর সদর উপজেলার। এছাড়া ফরিদগঞ্জের ২১জন, হাজীগঞ্জের ২১জন, মতলব উত্তরের ১১জন, শাহরাস্তির ৯জন, কচুয়ার ৭জন, মতলব দক্ষিণের ৬জন, হাইমচরের ৩জন মারা গেছেন। জেলায় শনাক্তকৃত ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতদের তথ্য থেকে এই পরিসংখ্যান করেছে সিভিল সার্জন অফিস। তবে এর বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদপুরে আরো অনেকে করোনায় মারা গেছেন। সেই তথ্য সিভিল সার্জন অফিসে নেই। তথ্য নেই দেশের বাইরে মারা যাওয়া চাঁদপুরের লোকজনেরও।

চাঁদপুর সদর হাসপাতালের করোনা বিষয়ক ফোকালপার্সন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, আমরা রোগীর চাপ সামাল দিতে যেয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা সবাই ক্লান্ত। এত রোগীর চাপ সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বেডের চেয়েও রোগী বেশি। সোমবার ৬০ বেডের আইসোলেশনে ৬২জন ভর্তি ছিল। করোনার রোগী তো অন্য ওয়ার্ডে ভর্তিও দেওয়া যাচ্ছে না। তাই উপজেলা হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র অক্সিজেন সমস্যার রোগীদের এখানে পাঠানো যেতে পারে। তাছাড়া নমুনা প্রদানকারীদের ভিড়ও দিন দিন বাড়ছে। উপজেলায় নমুনা গ্রহণের হার বাড়ানো দরকার।

কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সালাউদ্দীন মাহমুদ বলেন, আমাদের এখানে নমুনা দিতে লোকজন তেমন আসে না। তাই নমুনা সংগ্রহ কম। তবে নমুনা দিতে এখানে এসে কেউ ফেরত যায় না। এমনকি লোকজন টিকা দিতেও অসে না। এ কারণে অনেক টিকা ফেরত পাঠিয়েছি। তিনি জানান, সপ্তাহে ২ দিন (শনি ও বুধবার) নমুনা সংগ্রহ করা হয় কচুয়ায়। অন্যদিন হয় না। গাড়ির সমস্যার কারণে নিয়মিত নমুনা পাঠানো যায় না বলেও জানান তিনি। তবে তিনি আশা করছেন পরিবহন সমস্যা সহসা দূর হবে।

তিনি আরো জানান, ৮ বেডের আইসোলেশনে রোববার ১জন ভর্তি আছে। হাইফ্লো সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা না থাকায় এই হাসপাতালে করোনায় আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতেও আগ্রহী নন বলে তিনি দাবি করেন। অক্সিজেনের সমস্যা হলে আক্রান্তদের ভর্তি না দিয়ে চাঁদপুর রেফার করা হয়।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমাদের হাসপাতালে ভর্তিকৃত করোনা রোগী নাই। আক্রান্তরা হোম আইসোললেশনে আছে। তবে করোনা রোগীদের ৭টি বেড প্রস্তুত রাখা আছে। উপসর্গে আক্রান্ত ও শনাক্তকৃতরা সবাই সদরে চলে যায়। এ কারণে নমুনা কম। নমুনা সংগ্রহে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগটি সঠিক নয়। সপ্তাহে ২ দিন (রবি, বুধবার) নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর বাইরে ডিমান্ড অনুযায়ী অন্য দিনও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা হয় শনাক্তকৃতদের।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, উপজেলায় অনেকে নমুনা দিতে ও চিকিৎসা নিতে চায় না। গ্রামের মানুষের অবহেলা ও আগ্রহ কম। সে কারণে উপজেলাগুলোতে নমুনা সংগ্রহ ও ভর্তির হার অনেক কম। সদরে যারা ভর্তি হয় সবাই টেস্টের আওতায় আসেন। এ কারণে এখানে শনাক্ত বেশি। তবে উপজেলা চিকিৎসকরা দায়িত্ব অবহেলা করেন বলে মনে হয় না। এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।

তিনি আরো বলেন, রেপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে করোনা টেস্ট চালু হওয়ায় এখন নমুনা ও শনাক্ত বাড়বে বলে আশা করি। উপজেলাগুলোতে ২ হাজার অ্যান্টিজেন কিট পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া সদরের আইসোলেশনে রোগী বাড়ায় সোমবার আমি সব উপজেলায় নির্দেশনা দিয়েছি সেখানে যাতে করোনা রোগী ভর্তি করানো হয়। শুধুমাত্র অক্সিজেন সমস্যায় মারাত্মকভাবে ভোগা রোগীদের জেলা সদর হাসপাতালে পাঠাতে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন