চাঁদপুর প্রবাহের আত্মপ্রকাশ ও আমার যুগলবন্দীর সূচনা

পাহাড় কন্যা ভুটানের এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে লেখক। -ফাইল ছবি।

রহিম বাদশা :
প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্যে টইটুম্বুর আষাঢ়ের প্রথম প্রভাত, ঋতুরাণী বর্ষার প্রথম সকাল। রিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছিল। টিনের চালের নিচে গভীর ঘুমের মধ্যেও সেই মৃদুমন্দ বৃষ্টির টাপুরটুপুর শব্দ অনুভব করছিলাম। রাতভর উদ্বোধনী সংখ্যার কাজ করে নিদ্রা যেতে ভোর হয়ে গিয়েছিল। সকালেই আবার আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। বাধ্য হয়েই ঢুলো চোখে নিদ্রাভঙ্গ করতে হলো।

কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই বিস্মিত হলাম অজানা মানুষের উপহার দেখে। র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানে একটি গিফটের প্যাকেট আমার পড়ার টেবিলে দেখে এই বিষ্ময়। রুমমেট মামুন ভাই জানালেন, সকাল বেলা দু’জন বোরকা পরিহিত মেয়ে এসে এই উপহার দিয়ে গেছেন।

বলছিলাম ১৫ জুন, ২০০১ সালের কথা। দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের দিন। চাঁদপুর সরকারি কলেজের অনার্সের ছাত্র হিসেবে আমি তখন জিয়া হোস্টেলে থাকতাম। প্রাথমিকভাবে ধারণা করলাম পত্রিকার আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে হয়তো কোনো শুভাকাঙ্খী এই উপহার রেখে গেছেন।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থাকায় এ নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না সে সময়। তাছাড়া আগের ক’দিন অবিরাম দিন-রাত কাজ করতে হয়েছে উদ্বোধনী সংখ্যার জন্য। ফলে ক্লান্তি এসে ভর করেছিল ভাবনার জগতেও।

আগের দিন ১৪ জুন সারাদিনের পর প্রায় সারারাত কাজ করতে হয়েছে। মধ্যরাতে অন্যরা চলে গেলেও শেষ মুহূর্তের কয়েকটি পৃষ্ঠার মেকআপ (পৃষ্ঠাসজ্জা) দেখানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এর আগে ক’বছরের সাংবাদিকতার ধারণা থাকলেও পত্রিকার পেস্টিংয়ের মেকআপ দেখানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না আমার। যদিও চাঁদপুর প্রবাহের আগে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত দু’টি দৈনিকেই কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল।

অভিজ্ঞতাহীন অদক্ষ এই সংবাদকর্মীর উপর দায়িত্ব পড়ে চাঁদপুর প্রবাহের বিশাল (এ যাবৎ কালের জেলার সর্বোচ্চ) কলেবরের উদ্বোধনী সংখ্যার মেকআপ দেখানোর। যদিও প্রথম পৃষ্ঠাসহ অনেকগুলো পৃষ্ঠার মেকআপে নির্দেশনা দেন পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক মাকসুদ ভাই (শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম)।

রাত তখন ২টা। সিরাজ অফসেট প্রেসে চলছিল উদ্বোধনী সংখ্যা ছাপানোর শেষ মুহূর্তের কাজ। কম্পিউটারের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। সকালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করে আমাকে আর পেস্টার পারভেজ খানকে রেখে সবাই আপন আলয়ে ফিরে গেলেন।

তখনো পত্রিকার ৮ পৃষ্ঠার পেস্টিং বাকী। ক’দিনের টানা পরিশ্রম আর বহু ঘন্টার ঘুম বকেয়া পড়ে থাকায় রাজ্যের ঘুম ও ক্লান্তি এসে ভর করলো আমাদের দু’জনের দেহ-মনে। কিন্তু সকালের আগেই পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা বিশ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।

শুরু হলো পালাক্রমে স্বল্পকালের ঘুম। কয়েক মিনিটের জন্য আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে পারভেজ খান আমার তন্দ্রায় বিঘ্ন ঘটাতেন। আর তার তন্দ্রা দেখলে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াতাম। এভাবেই এগিয়ে চলছিল কাজ।

রাত ৩টার দিকে পেস্টিংয়ের শেষ ফর্মার কাজ চলছিল। তখনো দেড় পৃষ্ঠা খালি। আর কোন নিউজ, আর্টিকেল বা বিজ্ঞাপন নেই। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এত রাতে সম্পাদক কিংবা অন্য কাউকে ফোন দেওয়াও অশোভন মনে হলো। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি।

পারভেজ খান আর আমি কিছু সময় স্থির হয়ে রইলাম। হঠাৎ মাথায় এলো দু’টি বিজ্ঞাপন তৈরী করলেও তো হয়! কিন্তু কার বিজ্ঞাপন দেব? তাৎক্ষণিক মাথায় আসলো পত্রিকার প্রকাশক এ কে এম শফিক উল্যা সরকার তো ব্রিকফিল্ডের মালিক। কম্পিউটারে বসে তার ব্রিকফিল্ডের নামে পুরো পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন তৈরী করলাম। পাশাপাশি আরেকটি বিজ্ঞাপন করলাম অর্ধপৃষ্ঠার। এভাবেই কাজ শেষ করতে করতে ভোর হয়ে গেল।

কিভাবে সারাটি রাত কেটে গেল বুঝতেই পারিনি তখন। আর আজ এতগুলো বছর পর এসে বুঝতে পারছি না কিভাবে কিভাবে চাঁদপুর প্রবাহের ১৯টি বছর কেটে গেল। যদিও চাঁদপুর প্রবাহের সাথে আমার সম্পর্ক এর জন্মেরও (আত্মপ্রকাশ) আগে, সেই আতুরঘর (প্রস্তুতি পর্ব) থেকে। মাঝে ২০০৪ সালে কয়েক মাসের অপ্রত্যাশিত স্বেচ্ছায় গৃহীত ছুটি বাদ দিলে চাঁদপুর প্রবাহের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘকালীন কর্মীদের একজন হয়ে রইলাম।

চাঁদপুর প্রবাহের কুড়িতম জন্মদিনের এই ক্ষণে আজ মনে পড়ছে প্রতিষ্ঠাকালীন সকল সাংবাদিক কলাকুশলীকে। চাঁদপুর প্রবাহ তখন সাংবাদিক, কলাকুশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীতে ভরপুর ছিল। জেলা শহরের আর কোনো পত্রিকায় এতজন কর্মী কখনো কোনো গণমাধ্যমে কর্মরত ছিল কিনা সে নিয়ে আমার সংশয় আছে।

বার্তা বিভাগ, কম্পিউটার বিভাগ, বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশনসহ বিভিন্ন বিভাগের বিপুল সংখ্যক কর্মী বাহিনী ছিল চাঁদপুর প্রবাহের সূচনালগ্নে। সময়ের প্রয়োজনে নিদারুণ বাস্তবতায় তাদের অনেকেই আজ চাঁদপুর প্রবাহের সাথে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাদের শ্রম-ঘাম-ত্যাগের ফসল এই পত্রিকা।

পত্রিকার মালিক ও প্রকাশক এ কে এম শফিক উল্যা সরকার আজ আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তার শূন্যতা আজও আমরা উপলব্ধি করি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলমের অভিভাবকত্বের অভাবও অনুভব করি।

চাঁদপুর প্রবাহের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মীদের মধ্যে বার্তা বিভাগের মাহবুবুর রহমান সুমন, গাজী মোঃ শাহজাহান, বশির আহমেদ দেওয়ান, ইলিয়াছ খান নিজেল, আবদুস সালাম সুমন অসামান্য পরিশ্রম করেছিলেন।

পরবর্তীতে চাঁদপুর প্রবাহের বার্তা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এ এইচ এম আহসান উল্লাহ, রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ, জি এম শাহীন, আবদুল গনি, চৌধুরী ইয়াছিন ইকরাম, এ কে আজাদ, বাদল মজুমদার, অভিজিত রায়সহ আরো অনেক সহকর্মী আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়ায় কর্মরত। চাঁদপুর প্রবাহের অগ্রযাত্রায় তাদের অবদান ভুলার নয়।

২০০১ সালের ট্যাবলয়েড সাইজের চাঁদপুর প্রবাহ আজ ব্রডশিট সাইজের নিয়মিত দৈনিক। অধুনা যুক্ত হয়েছে পত্রিকার সার্বক্ষণিক চলমান নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক ফেইজ। ছাপা পত্রিকার কলেবর দ্বিগুণ হলেও কাজ বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু আজ হাতে গোনা ক’জনকে নিয়ে সামাল দিতে হয় নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশনা ও ওয়েবসাইট আপডেটের বিশাল কর্মযজ্ঞ।

এ কাজে বার্তা বিভাগের অপরিহার্য প্রধান হিসেবে অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন বার্তা সম্পাদক আল-ইমরান শোভন। সুদীর্ঘকাল ধরে চাঁদপুর প্রবাহ পৃথক কম্পিউটার অপারেটরবিহীন একটি পত্রিকা অফিস। এতেও শোভনের অপরিসীম ত্যাগ উল্লেখ না করলেই নয়।

তাছাড়া আমাদের সকল কর্মী নিজেদের কম্পোজের কাজ নিজেরাই করেন। করোনাকালে বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সম্ভবত আমরাই প্রথম নিজ নিজ বাসাকে অস্থায়ী বার্তা বিভাগে পরিণত করেছি।

মোরশেদ আলম রোকন, আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল, তালহা জুবায়ের, কবির হোসেন মিজি, শাওন পাটওয়ারী, শরীফুল ইসলাম, আল-আমিনসহ এক ঝাঁক তরুণ তুর্কীর সমন্বয়ে চাঁদপুর প্রবাহের বার্তা বিভাগের কর্মীরা ছুটিহীন অবিরাম দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

পত্রিকার বার্তা বিভাগে যুক্ত থেকেও একাই সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন বিভাগের দেখভাল করছেন এই পত্রিকার আরেক অপরিহার্য দায়িত্বশীল হাসান মাহমুদ। তার কাজের ক্ষেত্রের কোনো সীমা-পরিসামা নেই। সব কাজের কাজী তিনি।

যে ঘটনা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেটি দিয়েই ইতি টানতে চাই। চাঁদপুর প্রবাহের আত্মপ্রকাশের প্রথম প্রভাতে পাওয়া আমার সেই বিশেষ উপহার দেওয়া লোকটির সন্ধান অল্পকাল পরেই পেয়েছিলাম। উপলক্ষও জেনেছিলাম।

তিনি আমার তৎকালীন সহপাঠী আর আজকের সহধর্মিনী রোকেয়া বেগম মিলি (বর্তমানে রোকেয়া রহিম মিলি)। সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হলেও ‘সহ’ আদ্যাক্ষর অটুট রয়েছে। সে সময়কার প্রিয় বন্ধুটির সাথে ভালো লাগা, ভালোবাসার অনানুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল সেই ১৫ জুন, ১লা আষাঢ়। চাঁদপুর প্রবাহের মতোই তার সাথে আমার জীবন প্রবাহমান। আর আমার সারাবেলাজুড়ে সতত প্রবাহিত চাঁদপুর প্রবাহ।

-লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)