ট্রাম্প জিতলেইবা কী বাইডেন জিতলেইবা কী

-মুহম্মদ শফিকুর রহমান-

“…Government of the people, for The people, by the people…”

আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট (১৮৬১ থেকে ১৮৬৫), বলা যায় দেশটির শ্রেষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট এবং অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার জজ আব্রাহাম লিংকনের এই বাণী বিগত আড়াই শ বছর ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে যাচ্ছে। গৃহযুদ্ধের পর জজ আব্রাহাম লিংকন যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, তারই অংশ বাণীটি। লিংকনকে বলা হয় তিনি আমেরিকার জনগণের নৈতিক মানবাধিকারই কেবল সংরক্ষণ করেননি, সঙ্গে সঙ্গে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন এবং আমেরিকান অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেন। সেই আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আজ কেমন আছে? এবারের ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম জো বাইডেনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের যে চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে, তা কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ? বিশ্বের কাছে কতখানি সমর্থনযোগ্য?

শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জিতেই যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। মোটামুটি হোয়াইট হাউসের কাছাকাছি এসে গেছেন। আর এক ধাক্কা। তারপরও কথা থাকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট কী ভূমিকা পালন করবেন তার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। ট্রাম্প শিবির ইতোমধ্যেই বিভিন্ন আদালতে মামলা ঠুকেছে। এর একটি মামলাও যদি সুপ্রিম কোর্টে যায় তাহলে বাইডেনের ভাগ্যও আল গোরের মতো হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। শুক্রবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বাংলাদেশের টিভি স্ক্রিনে যা দেখা গেছে তাতে ইলেকট্রোরাল কলেজ ভোট বাইডেনের ঘরে ২৬৪ আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের থলিতে ২১৪। আরো কয়েকটি রাজ্যে তখনো ভোট গণনা চলছিল। জো বাইডেনের জেতার জন্য প্রয়োজন ২৭০ ইলেকট্রোরাল কলেজ ভোট। পপুলার ভোটেও জো বাইডেন এগিয়ে। দরকার ৬ ইলেকট্রোরাল ভোট। নাভাডা অঙ্গরাজ্য কী করবে, তা দেখার বিষয়। তবে বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম নির্বাচনের আগেই ১০ কোটি ভোটদাতা ভোট দিয়েছেন।

এসব নিয়ে ট্রাম্প শিবির ইতোমধ্যে রাজ্যে রাজ্যে অনেকগুলো মামলা করেছে। অভিযোগ অনিয়মের। মামলার কিছুসংখ্যকও যদি সর্বোচ্চ আদালতে যায় তাহলে কী ঘটবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির মধ্যে ট্রাম্প সমর্থক ৬ জন এবং জো বাইডেন ৩ জন। একটি উদাহরণ তো আছেই। বিল ক্লিনটনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর যেবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেন, তাতে তিনি জিতেছিলেন বলে তখনকার মিডিয়ায় দেখা গেছে। আল গোরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রিপাবলিকান জুনিয়র বুশ। সেদিন আদালতে মামলা হলে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে জুনিয়র বুশকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। আর ওই কমিটি করেছিলেন স্থানীয় বুশের ছোট ভাই জেব বুশ। একসময় আমরা বলতাম আমেরিকার অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চা হয় সুন্দরভাবে কিন্তু আটলান্টিক পার হলে তাদের আর গণতন্ত্রের কথা মনে থাকে না। এবং সে ক্ষেত্রে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট কোনো পার্থক্য নেই। যেই লাউ সেই কদু। ইরাক-আফগানিস্তানকে শ্মশান বানিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, ইরাকের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে পুত্রসহ যেভাবে হত্যা করা হলো কিংবা লিবিয়ার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হলো, তা গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় পড়ে, আমার জানা নেই। রীতিমতো বর্বরতা। আমেরিকা পৃথিবীর দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী নেতাদের যেভাবে হত্যা করেছে এবং নির্লজ্জের মতো তা গর্বভরে বলছে। কোনো অপরাধবোধ নেই। তারা নাকি সিভিলাইজড? ভবিষ্যতে আর কাকে হত্যা করবে, তা তারাই জানে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, চিলির ড. আলেন্দে, মিসরের আনোয়ার সাদাত, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকার্নো, বার্মার জেনারেল অং সান, এমনকি সৌদি আরবের কিং ফয়সাল হত্যাকাণ্ডের পেছনেও যে আমেরিকার হাত, তা কেউ অবিশ্বাস করবে না। তবে তারা সরাসরি নিজেরা এসে হত্যা করেছে কেবল সাদ্দাম, গাদ্দাফিকে। অন্যদের হত্যা করিয়েছে সেইসব দেশের মিলিটারি বা ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে। যেমন বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল মিলিটারি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, নুরুল ইসলাম মনজুর ও বিভ্রান্ত মিলিটারি সদস্য। আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তান যে কতখানি আমেরিকার চামচা ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ধারকৃত ও প্রকাশিত সিক্রেট ডকুমেন্টে।

ট্রাম্প জিতলেইবা কী বাইডেন জিতলেইবা কী

আমেরিকা এমন একটি দেশ যে দেশের আয়তন ৯৮ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৫ বর্গকিলোমিটার। সেই তুলনায় জনসংখ্যা ৩২ কোটি ৫০ লাখ ১২ হাজার। অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে ভূমির দিক থেকে ৪৯টি বাংলাদেশের সমান এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে মাত্র দ্বিগুণ। যে কারণে দেশটি যা খুশি তা-ই করতে পারছে। আমেরিকার জনগণের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় ৫৭ হাজার মার্কিন ডলার। আমাদের তুলনায় ২৮ গুণ। এটি একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এর সরকারের স্ট্রাকচার হলো প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, আইনসভা, কংগ্রেস, সিনেট (উচ্চকক্ষ) সদস্যসংখ্যা ১০০, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্নকক্ষ) সদস্যসংখ্যা ৪৩৫। দেশটি ব্রিটেন থেকে যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে ১৭৭৬ সালে, স্বীকৃতি লাভ করে ১৭৮৩ সালে এবং সংবিধান রচনা করে ১৭৮৮ সালে। এ ছাড়া ১৮৬০ সালের দিকে রুরাল সাউথ আমেরিকা এবং শিল্পোন্নত উত্তর আমেরিকার মধ্যে একটি যুদ্ধ বাধে এবং সেই যুদ্ধে শিল্পোন্নত উত্তরাঞ্চল জয়লাভ করে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের দাস প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। দ্য রুটস (THE ROOTS) নামে একটি মুভি দেখেছিলাম। ইন্টারেস্টিংলি ওই মুভিটি নির্মাণ করে আমেরিকা, এর নামই ভণ্ডামি। তাতে দেখানো হয় কীভাবে আফ্রিকার গরিব দেশগুলো থেকে কালো মানুষদের পায়ে কোমরে শেকল বেঁধে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হতো দাস হিসেবে। আলেক্স হেলি নামে একজন বিখ্যাত লেখক (ব্লাক আমেরিকান) দ্য রুটস রচনা করেন। এতে দেখানো হয় কালো আফ্রিকার একটি দেশ থেকে (সম্ভবত গিনি) কুন্টা কিন্টে নামের এক যুবককে পায়ে কোমরে শেকল বেঁধে আমেরিকা নিয়ে যায়। নৌকা বাইতেও তাকে বাধ্য করা হয়। টায়ার্ড হলেও ক্ষমা নেই, চাবুক খেতে হতো।

আমেরিকার আদি মানুষ ছিল ভারতবর্ষ থেকে যাওয়া। কলম্বাসরা আমেরিকার সন্ধান পাওয়ার পর রেড ইন্ডিয়ান নামের মানুষগুলোকে হত্যা করে। তাদের এবং তাদের বংশধরদের এখন ইতিহাস আছে, মানুষ নেই। এই হচ্ছে তথাকথিত বিশ্বসভ্যতার একটি উদাহরণের খণ্ডচিত্র। এরা মানুষ হত্যা করে এবং দম্ভ করে তা উচ্চারণ করে। যদিও মার্কিন সরকারব্যবস্থা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে। শুরু থেকেই এর সরকারব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এই ব্যবস্থায় নাগরিকরা তাদের নিজেদের নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের শাসন করে। মার্কিন গণতন্ত্রে কতগুলো আদর্শ আছে, যেমন জনগণকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে নিতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান। এই আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারব্যবস্থা ৪টি উপাদান দিয়ে গঠিত, ১. জনগণের সার্বভৌমত্ব, ২. প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, ৩. ক্ষমতার ভারসাম্য ও ৪. ফেডেরালবাদ, যেখানে সরকার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা অংশীদারি করা হয়।

সুন্দর শাসনব্যবস্থা। যদিও রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সিনেট বা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের মতো। অথচ এই দেশটি অর্থাৎ এই দেশের শাসকরা বিশ্বের কোনো দেশের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার সমর্থন করে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তানকে সব রকম সহায়তা দিয়েছে। তারপরও যখন দেখল তাতে কাজ হচ্ছে না তখন ফাইটার বা যুদ্ধজাহাজবাহী সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত আমাদের সাহায্য না করলে আমাদের উড়িয়ে দিত। তাদের সপ্তম নৌবহরের মোকাবিলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের রেড ফ্লিট পাঠিয়েছিল বলে মার্কিনরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে তাকালে তাদের ভণ্ডামির বীভৎস চিত্র ধরা পড়বে। সেদিন চীন তাদের সহযোগী ছিল এবং আমাদের বিরুদ্ধে ভেটোও দিয়েছিল। এবার অবশ্য ধরা খেয়েছে। ট্রাম্প বাহিনীর সঙ্গে জো বাইডেন বাহিনীর কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়ে গেছে। একেবারে প্রেসিডেন্ট হাউস হোয়াইট হাউসের সামনেই। আরো অনেক জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের নির্বাচনে ওরা পর্যবেক্ষক বাহিনী পাঠায়। এবার বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ পর্যবেক্ষক পাঠালে আমেরিকার নেকাব খুলে যেত, এটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। ট্রাম্প প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন হোয়াইট হাউসে সেই থাকবে। এমনকি বাইডেন বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য হোয়াইট হাউসের চারদিকে ট্রেন্স বা পরিখা খনন করেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

আমাদের দেশে একটা ধারণা আছে যে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি উগ্র এবং সংখ্যালঘুবিরোধী; পক্ষান্তরে জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টি অনেক সহনীয় অর্থাৎ পরমতসহিষ্ণু। কথাটা কি ঠিক? ডেমোক্র্যাটদের শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্যে কি ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি? এখানে তাদের টার্গেট ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ। আমেরিকার একটি অঙ্গরাজ্য সম্ভবত ওহাইও, তাতে ৭০ বছরের তেল-গ্যাস মজুত করা আছে। তারপরও মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল তেলই নয় বরং ইরাকের প্রাচীন মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি লুট করে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসকেন্দ্রিক ১০ হাজার বছরের যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকে ধ্বংস করে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট কেউই কম যায় না। দুই দলই তখন ক্ষমতায় ছিল, আগে ও পরে। কাজেই ট্রাম্প জিতলেইবা কী জো বাইডেন জিতলেইবা কী? আমরা আব্রাহাম লিংকনকেই মনে রাখব।

ঢাকা, ৬ নভেম্বর ২০২০
-লেখক : সংসদ সদস্য, সদস্য, মুজিববর্ষ জাতীয় কমিটি, সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব।
ই-মেইল: balisshafiq@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)