২১ আগস্ট : ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়


দুলাল আচার্য :
২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার স্মৃতি-বিজড়িত দিন। বিশ্বের সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই হামলা চালানো হয়। হামলার মূল টার্গেট ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। নৃশংস সেই হামলায় মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। হামলায় দলটির প্রায় পাঁচশ’ নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। হামলার শিকার অনেকেই এখনও শরীরে ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রেনেড হামলায় আহতদের মধ্যে ঢাকার মেয়র হানিফ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকেই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তাঁর শ্রবণেন্দ্রীয় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্নমত থাকবে। সেই মত জনমুখী করতে রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তা তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো দলকে নিশ্চিহ্ন করা বা দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্র কোনো সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যে এ ধরনের হামলা সম্ভব নয়- তাও আজ স্পষ্ট।
তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার এ ঘটনার পর তদন্তে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়নি। বরং ঘটনার পর পরই সরকারের প্রভাবশালী মহল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ ভবনের সম্পৃক্ততার কথা, ঘটনার পর আলামত নষ্ট করা, এফবিআই-এর তদন্ত দলকে সহযোগিতা না করার মতো জঘন্য কাজ করেছিল ক্ষমতাসীন জামায়াত-বিএনপি সরকার। শুধু তাই নয়, পরে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নাটকের অবতারণা করেছিল তারা। তারা যে বিশেষ বাহিনীর কতিপয় সদস্যকেও ব্যবহার করেছিল তাও আজ প্রতীয়মান। হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এমন কথাও বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন সংসদেও তাঁরা অনুরূপ মিথ্যাচার করে।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আদালত এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আরো কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে একটি সম্পূরক চার্জশীট আদালতে জমা দেয়া হয়। এতে সাক্ষ্য-তদন্তের ভিত্তিতে অভিযুক্ত হিসেবে আরও অন্তর্ভুক্ত হন তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিবসহ ত্রিশ জন। ফলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। ২০১১ সালের আগস্ট মাসে পলাতকদের বিরুদ্ধে আদালত দেশের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। বিজ্ঞাপন ছাপার পর কেউই আত্মসমর্পণ করেননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। প্রায় ১৬ বছর আগে নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তদানীন্তন বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। মামলার মোট ৪৯ আসামীর মধ্যে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেয়া হয়েছে। তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক।

১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। চারটি মামলার রায় ইতোমধ্যে ঘোষণা হয়েছে। এসব হামলার কমপক্ষে ৬০ জন দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলোও বিচার পায়নি। হত্যাচেষ্টা ঘটনায় মামলা হয়নি, এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে। ২১ আগস্ট তার একটি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মিছিল পূর্ব সমাবেশে তৎকালীন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলা অন্যতম। এই হত্যাচেষ্টাটি হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, ঘাতকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অপকৌশল প্রয়োগের সময় হিসেবে বারবার বেছে নিয়েছে আগস্ট মাসকে।

ইতিহাসের আরেক নির্মম অধ্যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন ভোররাতে এক নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূসহ কেউই রক্ষা পাননি সেই রাতের হত্যাকান্ড থেকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে টানা ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতেও দেয়া হয়নি। সেদিনকার খবরের কাগজগুলোতেও গুরুত্ব পায়নি এই মহানায়কের নির্মমভাবে প্রস্থানের সংবাদ। বিশ্বাসঘাতকার ফলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়েছিলেন মীরজাফর খ্যাত খন্দকার মোশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারকার্য। তারপর বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম, শুরু হয় সামরিক শাসন। চলে টানা ১৫ বছর। বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েম দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টাকালে ১৯৭৭ সালে আবু সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতা দখল করেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনিই সেই মেজর জিয়া, যিনি আজকের বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। মুজিব হত্যাকান্ডের পর সেনাকর্মকর্তা শাফায়াত জামিলের কাছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে বিস্মিত না হয়ে বলেছিল, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ মেজর জিয়া ক্ষমতা, লোভ ও হত্যাযজ্ঞের ওপর ভিত্তি করে যেই বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল, জনমনের বিপরীত ধারায় অবস্থান করেও সেই দলটি আজও ক্ষমতা দখল ও নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে রয়েছে। দলটি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই স্বাধীনতার সপক্ষীয় শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে।

গণতন্ত্রকে রক্ষা, জঙ্গিবাদকে নির্মূল ও অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই ভেবেই হামলাকারীরা তাঁর নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য বারবার আঘাত করেছে। ঘৃণ্য ওই গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন সরকার অপরাধীদের রক্ষায় যে তোড়জোড় শুরু করে তা সভ্য সমাজে কল্পনা করাও কঠিন। আক্রান্ত আওয়ামী লীগকেই এ হামলায় জড়িত প্রমাণের চেষ্টা তখনকার তদন্তকে পরিণত করে প্রহসনে। প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিতে, তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঘটনার আলামত নষ্টসহ হেন কোনো চেষ্টা নেই যা করেনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। জজ মিয়া নামক এক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে মাসোহারা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আসামি বানানো ছাড়াও শৈবাল সাহা পার্থসহ ২২ জনকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে সাজানো স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়। এমনকি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এতে গ্রেনেডের উৎস, মদদদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কে অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যায়। কিন্তু ‘সত্যের জয় নিশ্চয়’ সত্যটুকু ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীরা ভুলে যায়। এই সেই সত্যটুকুই জানিয়ে দিল। এখন দরকার ঘাতকদের রায় কার্যকর করা। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের হাতে সোপর্দ করার উদ্যোগ নেয়া দরকার সরকারের। সময় এসেছে এই অপশক্তিকে রুখতে হবে। প্রবাদ আছে, কঞ্চি বড় হওয়ার আগেই কেটে ফেলতে হবে। জনগণকে সামনে নিয়ে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার এখনই সময়। এই অপশক্তি ক’বছর আগেও অগ্নিসন্ত্রাস, পেট্রোল বোমা হামলায় মানুষ পোড়ানোর ঘটনার পরেও ক্ষমতা পুঞ্জীভ‚ত করতে না পেরে ওরা নানা ষড়যন্ত্রের সুযোগ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

আসলে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার প্রয়োজন। বোমা বা গ্রেনেড দিয়ে কাউকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা নয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে কলুষিত করেছে। তবে সম্প্রতি রায় প্রকাশের মধ্যদিয়ে অনেক নাটকের জন্ম দেওয়া এ মামলাটি অবশেষে প্রাণ ফিরে পেল। তদন্তে বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য। সত্য কখনও চাপা থাকে না, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মধ্য দিয়ে সে সত্যটি আবারও প্রমাণিত হলো।

-লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)