তালহা জুবায়ের :
‘জাটকা অভিযানের পরেত্তনে নৌকা জাল লইয়া গাঙ্গো যাই, জাল হালাই, কিন্তু মাছ কই? যেমন জাল হালাই, টানার পরেও হেমন খালিই ওডে! ইলিশতো দূরে থাহোক, গাঙ্গো কোন মাছই না। ভাইগ্য বালা থাকলে জালে দুই চারইটা যাঅই ওডে, হেই দিয়া আমাগো নৌকার খরচের টেহাই অয়না, চাউল, ডাইল কিনমু কেমনে? আমগো সংসারের চাকা আর চলে না।’
নদীতে ইলিশ ধরতে গিয়ে কাঙ্খিত মাছের দেখা না পেয়ে এভাবেই হতাশার কথাগুলো বলছিলেন চাঁদপুর শহরের গুয়াখোলা এলাকার জেলে বিনয় বর্মন। তিনি বলেন, ‘দুঃখের কতা কি কমু ভাই, গত জাটকা রক্ষা অভিযানে দুই মাস বেকার সময় কাটছে। এর হের তনে দার দেনা কইরা সংসার চলছে। আশা ছিল সিজনে মাছ ধইরা ঋণ শোধামু, হেইডাতো অইলোই না, উল্টা অহন সংসার চালানোই দায় অইয়া পড়ছে। গাঙ্গো ইলিশ নাই কইলেই চলে। সারা দিন নদীতে জাল হালাইয়াও মাছের দেহা পাই না। গাঙ্গো ইলিশ নাই, আমগো দুঃখেরও শেষ নাই।’
বিনয় বর্মনের মতো একই চিত্র জেলার নিবন্ধিত প্রায় অর্ধলক্ষ জেলের। নদীতে মাছ না পাওয়ার হাহাকার জেলার দুই লক্ষাধিক জেলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে। ইলিশের মৌসুমে বুক ভরা আশা নিয়ে নদীতে নামছে জেলেরা। উদ্দেশ্য একটাই, মাছ ধরে কিছু টাকা আয় করে বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনদের ঋণের টাকা পরিশোধ করা। ইলিশ বেঁচে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাঁসি ফোটাবে।
কিন্তু নদীতে মাছ না পেয়ে জেলেদের লালিত স্বপ্ন পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। সারা দিন জাল ফেলেও কাঙ্খিত মাছ না পেয়ে দিন শেষে গোমরা মুখে ফিরতে হচ্ছে তাদের।এতে করে আর্থিক সংকটে পড়ে হতাশায় ভূগছে জেলার অর্ধলক্ষাধিক জেলে।
জেলে আব্দুল মালেক বলেন, ‘ইলিশের পোনা জাটকা রক্ষা অভয়াশ্রমে প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাহনে অনেক অসাধু জাউল্লা নির্বিচারে জাটকা ধরচে। তাই অহন মৌসুমেও আমরা মাছ পাইনা। আমরা অভিযানের সময় গাঙ্গে মাছ ধরিনাই। ধার দেনা কইরা চলছি, অহন মাছ না পাওয়নে পরিবার নিয়া কষ্টে দিন যাইতেছে।’
হাইমচর উপজেলার কাটাখালী এলাকার জেলে ফজল গাজী ও তারেক হোসেন বলেন, ‘নৌকা জাল নিয়া গাঙ্গে নামলে আমাগো হাজার ১২শ’ টেহা খরচ অয়। সারা দিন মাছ ধইরা চাইর পাচ জন বাগিদাররা দুই তিনশ’ টেহা লইয়াও বাইত যাইতে পারি না। এই টেহা দিয়ে চাউল কিনলে ডাইল কিনা যায় না। তরিতরকারি কিনমু কেমনে? সামনে ঈদ আইতেছে, বৌ-পোলাপাইনেরে যে কিছু কিন্না দিমু হেই উপাই নাই।’
এদিকে জেলেদের জালে ইলিশ না পাওয়ায় মাছ শূণ্য নদীর পাড়ের আড়ৎগুলো। মাছ না থাকায় অলস সময় কাটছে আড়ৎদারদের। ভরা মৌসুমেও আড়তে ইলিশ না আসায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তারা।
সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে মেঘনা নদীর পাড়ের দুই আড়ৎদার বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর নদীতে মাছ নাই কইলেই চলে। জেলে মাছ না পাওয়ায় আমাদের আড়তেও মাছ নাই। আমরা জেলেদেরকে লক্ষ লক্ষ টাকা দাদন দিয়া বেকার হইয়া রইছি। সারা দিনে দুই তিন হাজার টাকার মাছও আসে না আড়তে। আর আড়তে মাছ বিক্রি করতে না পারায় আমরা কমিশনও পাই না। জেলেদের মত আমরাও চোখে সর্ষে ফুল দেখতেছি।’
স্থানীয় নদীর ইলিশ সরবরাহ না থাকলেও ভোলা, বরগুনা হাতিয়াসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে কিছু ইলিশ সরবরাহ হচ্ছে চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছ ঘাটে। বর্তমানে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২শ’ মণ ইলিশ আসছে চাঁদপুর মাছ ঘাটে।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবে বরাত বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম চললেও স্থানীয় নদীতে ইলিশ নেই। জেলেরা ইলিশ না পাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ইলিশের বাজার চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছ ঘাটে। মৌসুমে এই বাজারে ৮-১০ হাজার মণ ইলিশ সরবরাহ হলেও বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১১শ’ থেকে ১৫ মণ ইলিশ। এসব ইলিশ ভোলা, বরগুনা হাতিয়া, সন্দীপসহ সমুদ্রাঞ্চলের মাছ। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ ৫০ মণও সরবরাহ হয় না। অথচ সারা বাংলাদেশে চাঁদপুরের ইলিশের অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মাছ না থাকায় আমরা বিক্রি করতে পারছি না। এতে করে কোটি কোটি টাকা ঋণ করে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিসুর রহমান বলেন, এবছর বৈশাখ মাসে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদীতে পানির ¯্রােত কম ছিল। তাছাড়া দিন দিন নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, নদীতে ডুবোচর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে জেলেদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আশাকরছি জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাবশ্যা পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে চলতি মাসের শেষ দিক থেকে নদীতে ইলিশ উঠে আসবে। অচিরেই ইলিশের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে নদীতে। রূপালী ইলিশে হাঁসি ফুটবে জেলেদের মুখে।
তিনি বলেন, গত বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে সাড়ে পাঁচ লক্ষ মেট্রিক টন। আশা করছি, সবকিছু ঠিক থাকলে এবছর দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড পৌঁনে ছয় লাখ টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।