প্রথম বছরের চেয়ে দ্বিতীয় বছর পরিস্থিতি ছিল আরো ভয়াবহ
রহিম বাদশা :
চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্তের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল চাঁদপুরে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত দুই বছরে জেলায় করোনা টেস্টের জন্য সর্বমোট ৮৯ হাজার ১২১জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২২জন (১২২.০৮) নমুনা দিয়েছেন। এর মধ্যে মোট ১৭ হাজার ৩৫৮জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। সে হিসেবে প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৪জন (২৩.৭৭)। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪৬জন। অর্থাৎ প্রতি ৩ দিনে ১জনের বেশি (১.০১) মানুষ মারা গেছেন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এই পরিসংখ্যান মূলত চাঁদপুর জেলায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত রিপোর্টের আলোকে প্রস্তুতকৃত। এছাড়া জেলায় আরো অনেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন, নিচ্ছেন। যাদের অনেকে মারাও গেছেন। প্রথম দিকে উপসর্গে কেউ মারা যাওয়ার খবর পেলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা মৃতের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করতো। এমন পদ্ধতিতেও কিছু মৃত্যু করোনাজনিত বলে জানা গেছে। কিন্তু বেশুমার মৃতের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি বা হয়নি নানা কারণে। আর এখন স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনায় মৃতদের নমুনা সংগ্রহ করাই হচ্ছে না। ফলে কার্যত আক্রান্ত ও মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তথ্য অজানাই থেকে গেছে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও চাঁদপুরে সন্দেহভাজন লোকদের নুমনা সংগ্রহ শুরু হয় ২৭ মার্চ। ওইদিন ঢাকার আইইডিসিআর থেকে বিশেষ টিম এসে চাঁদপুরের একজনের নমুনা সংগ্রহ করে। ২ এপ্রিল চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের তত্ত¡াবধানে চাঁদপুর জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। প্রথম দিনে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ থেকে ২জন করে মোট ১০জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। চাঁদপুর প্রবাহের আর্কাইভ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
উল্লেখিত সূত্রে আরো জানা যায়, চাঁদপুরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল। তার নাম মোঃ সুজন (৩২)। নারায়ণগঞ্জ ফেরত এই যুবক অসুস্থ অবস্থায় মতলব উত্তরে তার শ্বশুর বাড়িতে আসার পর ৬ এপ্রিল নমুুনা দিয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন।
প্রথম শনাক্তকৃত করোনা রোগী সুজনের নমুনা টেস্টের পজেটিভ রিপোর্ট আসার দিনেই (৯ এপ্রিল) চাঁদপুর জেলায় অনির্দিষ্টকালের লকডাউন ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক। ওইদিন সন্ধ্যায় এই লকডাউন কার্যকর শুরু হয়। টানা কয়েক মাস চলে সেই লকডাউন। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এখন আর লকডাউন নেই। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদপুরে এখনো লকডাউন প্রত্যাহার ঘোষণা করা হয়নি।
চাঁদপুরে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১১ এপ্রিল চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা এলাকায়। তিনিও নারায়ণগঞ্জ ফেরত। শ্বশুর বাড়িতে করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে। ১৫ এপ্রিল তার নমুনা টেস্টের রিপোর্ট আসে করোনা পজেটিভ। এরপর তার শ্বশুর ও এক শ্যালিকা করোনায় আক্রান্ত হন। শ্যালিকা সুস্থ হয়েছেন। আর শ্বশুর করোনা থেকে সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মারা যান।
চাঁদপুরে করোনার আগমন ও সংক্রমণের বাহক হিসেবে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরত লোকদের চিহ্নিত করেছে। প্রথম পর্যায়ে বিদেশ ফেরত লোকদের সন্দেহের শীর্ষে রাখা হলেও জেলায় বিদেশ ফেরত লোকদের মধ্যে করোনা তেমন সংক্রমণ দেখা যায়নি। চিকিৎসকদের মতে, গত বছরের শুরুর দিকে সারা জেলায় করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়। তবে বর্তমানে জেলায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। টিকার আওতায় এসেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ।
সিভিল সার্জন অফিসের হিসেবে, গত এক মাসে (১০ মার্চ-৯ এপ্রিল) জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৫৬জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২জনের কম (১.৮৬) আক্রান্ত হয়েছেন। এই সময়ে করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা যাননি। জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। জেলাবাসীর জন্য এই তথ্য স্বস্তিকর।
সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল ৯ এপ্রিল চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, দুই বছরে চাঁদপুর জেলায় ৮৯ হাজার ১২১জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রথম এক বছরে নমুনা দিয়েছিলেন ২১ হাজার ৮৭৮জন। পরের এক বছরে নমুনা দিয়েছেন ৬৭ হাজার ২৪৩জন। অর্থাৎ প্রথম বছরের চেয়ে দ্বিতীয় বছরে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তিনগুণেরও বেশি। দুই বছরে মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ৩৫৮জন। এর মধ্যে প্রথম বছরে আক্রান্ত হন ৩ হাজার ৫৩৫জন, দ্বিতীয় বছরে শনাক্ত হন ১৩ হাজার ৮২৩জন। সে হিসেবে, প্রথম বছরের চেয়ে দ্বিতীয় বছরে আক্রান্ত শনাক্ত হন প্রায় চারগুণ। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৪৬জন। এর মধ্যে প্রথম বছর মারা যান ৯৮জন এবং দ্বিতীয় বছর মারা যান ১৪৮জন। অর্থাৎ দ্বিতীয় বছরে মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।
এ পর্যন্ত (৮ এপ্রিল, ২০২২ খ্রি.) সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৮৩৮জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২৭৪জন। তবে বর্তমানে হাসপাতালের করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে কোনো রোগী ভর্তি নেই। আক্রান্ত সবাই হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর জেলায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ১৭ হাজার ৩৫৮জনের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ৭৫৪৯জন, ফরিদগঞ্জে ২০১৫জন, মতলব দক্ষিণে ১৩৯৫জন, হাজীগঞ্জে ১৭৪১জন, শাহরাস্তিতে ১৮৫০জন, মতলব উত্তরে ৯৬৩জন, হাইমচরে ৯০৫জন ও কচুয়ায় ৯৪০জন।
সূত্র আরো জানায়, করোনায় জেলায় মোট ২৪৬জন মৃতের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ১০১জন, হাজীগঞ্জে ২৭জন, ফরিদগঞ্জে ৩৫জন, মতলব উত্তরের ১৪জন, শাহরাস্তিতে ৩১জন, কচুয়ায় ১৩জন, মতলব দক্ষিণে ১৮জন ও হাইমচরে ৭জন।
উল্লেখিত পরিসংখ্যানের বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং বিদেশে চাঁদপুরের বহু লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন অনেকে। বিক্ষিপ্তভাবে তাদের অনেকের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো সরকারি-বেসরকারি কোনো সূত্র জানাতে পারেনি।