ছবি পরিচিতি : চাঁদপুর শহরে লকডাউন চলাকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সড়কে অবস্থানের ফাইল ছবি।
রহিম বাদশা :
চাঁদপুর জেলায় করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও লকডাউনের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে নমুনা (স্যাম্পল) পরীক্ষা করা লোকের মধ্যে শতকরা ১৩.১২ ভাগের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর শতকরা হার ১.১৪ ভাগ।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের জেলাগুলোর সাথে তুলনা করলে আপাত দৃষ্টিতে এই পরিসংখ্যান কিছুটা স্বস্তিদায়ক মনে হলেও অতি সম্প্রতি শনাক্তের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দু’টোই বেড়েছে।
সোমবার (৮ জুন) চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলায় করোনা টেস্টের জন্য মোট সংগৃহীত নুমনার পরিমাণ ২৩৮৫টি। এর মধ্যে রিপোর্ট এসেছে ২০০৪টি। সংগৃহীত নমুনার মধ্যে রিপোর্ট প্রাপ্তির শতকরা হার ৮৪.০২ ভাগ।
প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ২৬৩জন করোনায় আক্রান্ত। এ হিসেবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে আক্রান্তের হার শতকরা ১৩.১২ ভাগ। তবে অন্য জেলায় নমুনা টেস্টে আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর চাঁদপুরে অবস্থান করা লোকসহ জেলায় মোট করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৭৭জন। সে হিসেবে আক্রান্তের হার শতকরা ১৩.৮৮ ভাগ। এর মধ্যে ২৩জন মারা গেছেন। মৃত সবাই চাঁদপুরেই মারা গেছেন।
বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও চাঁদপুরে সন্দেহভাজন লোকদের নুমনা সংগ্রহ শুরু হয় ২৭ মার্চ। ওইদিন ঢাকার আইইডিসিআর থেকে বিশেষ টিম এসে চাঁদপুরের একজনের নমুনা সংগ্রহ করে।
২ এপ্রিল চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের তত্ত্বাবধানে চাঁদপুর জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। প্রথম দিনে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ থেকে ২জন করে মোট ১০জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। চাঁদপুর প্রবাহের আর্কাইভ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
উল্লেখিত সূত্রে আরো জানা যায়, চাঁদপুরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৯ এপ্রিল। তার নাম মোঃ সুজন (৩২)। নারায়ণগঞ্জ ফেরত এই যুবক অসুস্থ অবস্থায় মতলব উত্তরে তার শ্বশুর বাড়িতে আসার পর ৬ এপ্রিল নমুুনা দিয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তিনি এখন সুস্থ।
প্রথম শনাক্তকৃত করোনা রোগী সুজনের নমুনা টেস্টের পজেটিভ রিপোর্ট আসার দিনেই (৯ এপ্রিল) চাঁদপুর জেলা লকডাউন ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক। ওইদিন সন্ধ্যায় এই লকডাউন কার্যকর শুরু হয়।
সরকারের কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে অনেকটা শিথিল পর্যায়ে লকডাউন এখনো বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান।
চাঁদপুরে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১১ এপ্রিল চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা এলাকায়। তিনিও নারায়ণগঞ্জ ফেরত। শ্বশুর বাড়িতে করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে।
১৫ এপ্রিল তার নমুনা টেস্টের রিপোর্ট আসে করোনা পজেটিভ। এরপর তার শ্বশুর ও এক শ্যালিকা করোনায় আক্রান্ত হন। শ্যালিকা সুস্থ হয়েছেন। আর শ্বশুর করোনা থেকে সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মারা যান।
চাঁদপুরে করোনার আগমন ও সংক্রমণের বাহক হিসেবে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরত লোকদের চিহ্নিত করেছে। প্রথম পর্যায়ে বিদেশ ফেরত লোকদের সন্দেহের শীর্ষে রাখা হলেও এখন পর্যন্ত জেলায় একজন বিদেশ ফেরত লোকেরও করোনা শনাক্ত হয়নি।
চিকিৎসকদের মতে, সারা জেলায় এখন করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন চলছে। গত এক সপ্তাহ ধরে চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত, আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং করোনার উপসর্গে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে।
সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, চাঁদপুরে জেলায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ২৭৭জনের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ১৩৭জন, ফরিদগঞ্জে ৪৪জন, হাজীগঞ্জে ২২জন, মতলব দক্ষিণে ২০জন, শাহরাস্তিতে ১৯জন, কচুয়ায় ১৬জন, মতলব উত্তরে ১৩জন ও হাইমচরে ৬জন।
এছাড়া জেলায় মোট ২৩জন মৃতের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ৮জন, কচুয়ায় ৪জন, ফরিদগঞ্জে ৪জন, হাজীগঞ্জে ৪জন, মতলব উত্তরে ২জন ও শাহরাস্তিতে ১জন।
চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, সারা জেলার প্রায় অর্ধেক (২৭৭/১৩৭) করোনা আক্রান্ত রোগী চাঁদপুর সদর উপজলায়। এর মধ্যে চাঁদপুর পৌর এলাকার রোগীর সংখ্যা ১২৬জন। মৃতের সংখ্যাও (২৩/৮) চাঁদপুর সদরে সর্বাধিক। সারা জেলার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সিভিল সার্জন আরো জানান, সর্বশেষ গতকাল সোমবার চাঁদপুর থেকে আরো ৯৯টি নমুনা পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। এ নিয়ে প্রেরণকৃত নমুনার সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩৮৫টি। রিপোর্ট এসেছে ২০০৪টি। রিপোর্ট অপেক্ষমান ৩৮১টি।
তিনি আরো জানান, জেলায় আক্রান্ত ২৭৭জনের মধ্যে ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৭৩জন। চিকিৎসাধীন আছেন ১৮১জন। এখন পর্যন্ত আইসোলেশনে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ১৩৫জন। এর মধ্যে ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ১১১জন।
বর্তমানে আইসোলেশনে রোগীর সংখ্যা ২৪জন। এছাড়া জেলায় মোট হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির সংখ্যা ৪৩৮৭জন। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৬৬৩জন। বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৭২৪জন।
উল্লেখিত পরিসংখ্যানের বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং বিদেশে চাঁদপুরের বহু লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন অনেকে। বিক্ষিপ্তভাবে তাদের অনেকের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো সরকারি-বেসরকারি কোনো সূত্র জানাতে পারেনি।