তালহা জুবায়ের :
পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় জেলা নদীবিধৌত চাঁদপুর। ইলিশের রাজধানী খ্যাত এই জেলায় মিলন ঘটেছে দেশের অন্যতম প্রধান তিন নদী পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার। রূপালী ইলিশের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নানা ঐতিহ্যময় দর্শনীয় স্থান। তিন নদীর মোহনা ও নদীর চরে ঘুরে বেড়াতে সারা বছরই পর্যটকদের পদচারনা দেখা যায়। পর্যটন খ্যাতের উন্নয়ণে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হলে চাঁদপুর হয়ে উঠতে পারে পর্যটকদের জন্য এক কাঙ্খিত নাম।
পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া এই তিন নদীর মিলনস্থলকে বলা হয় বড়স্টেশন মৌলহেড। অপরূপ সৌন্দর্যময় এই স্থানটি ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এক আরাধ্য নাম। নদীপথে আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন এই স্থানে। নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি পর্যটকরা নৌকায় চড়ে নদীতে ঘুরে বেড়ান। এসময় জেলেদের রূপালী ইলিশ ধরার দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। শীতকালে জেগে ওঠা চরে বেড়ানোর সুযোগ কোন ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাননা তারা। এই স্থানটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ভাস্কর্য ‘রক্তধারা’ যা দেখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে পারে পর্যটকরা। তাছাড়া রয়েছে রূপালী ইলিশের ভাষ্কর্য।
তবে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কিছু সমস্যায়ও পড়তে হয়। ময়লা-আবর্জনা, দুগন্ধের পাশাপাশি রয়েছে ভিক্ষুকের অত্যাচার। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য নেই কোন বিশ্রামাঘার, অপর্যাপ্ত বসার সিট, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, শহরে লেগে থাকা যানজট।
এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রেখে আরো আধুনিকায়নের দাবি এখানে ঘুরতে আসা জনসাধারণের। এই পর্যটন এলাকায় চাঁদপুরের বিখ্যাত ইলিশ ভোজনের জন্য একটি ভাসমান রেস্তোরাসহ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদীতে ক্যাবলকার বা ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করা হলে চাঁদপুরের পর্যটন শিল্পের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করেন পর্যটক ও সাধারণ মানুষ।
বন্ধুদের সাথে বড়স্টেশনে ঘুরতে আসা ফরিদগঞ্জের সিয়াম বলেন, এই জায়গাটির একটি বিশেষ ভালোলাগা আছে। বাংলাদেশের আর কোথাও তিন নদী একসাথে মিলিত হয়েছে কিনা জানা নেই। এখানে বর্ষায় এক ধরনের সৌন্দর্য দেখা যায়, শীতকালে আরেক রকম।
পুরানবাজারের বাসিন্দা আশিক বিন রহিম বলেন, বড়স্টেশনের আশপাশে যদি একটি ভাসমান রেস্তোরা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেখানে পর্যটকরা এসে রূপালী ইলিশের বিভিন্ন রেসিপির স্বাদ নিতে পারবে। তাছাড়া ডাকাতিয়া নদীর উপরে ক্যাবলকার বা ঝুঁলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করা যেতে পারে। শহরের মধ্যে ৩টি লেক রয়েছে। এগুলোকে যদি পরিকল্পিতভাবে সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে আরো সুন্দর হয়ে উঠবে চাঁদপুর।
কুমিল্লা থেকে আসা ওমর ফারুক বলেন, সময় পেলেই বড়স্টেশন নদীর পাড়ে ঘুরতে আসি। জায়গাটি অনেক সুন্দর। অনেক উন্নত দেশেও এতো সুন্দর জায়গা নেই। এখানে নৌকায় ঘুরার পাশাপাশি নদীর চরে বেড়াতেও অনেক ভালো লাগে।
এই শহরের প্রাণ কেন্দ্রে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমির শৈল্পিক ও আঙ্গিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত লেকের উপর নির্মিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য অঙ্গীকার। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সব সময়ের জন্যে। শহরের বুকে বহমান ৩টি লেক পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তুলতে পারে নতুন পর্যটন কেন্দ্র। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে ‘রূপসা জমিদার বাড়ি’, শাহরাস্তি উপজেলায় রয়েছে মেহের কালীবাড়ি মন্দির। যা দেখতে দর্শনার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে চাঁদপুরে ছুটে আসেন।
শহরের অদূরে ষোলঘরে রয়েছে একটি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র। এখানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত জাতের মৎস্য পোনা উৎপাদনের জন্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখানে রয়েছে একটি মৎস্য জাদুঘর। এই জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট অনুপম সুন্দর ‘হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ। যা ১৩৪৪ সালে (হিজরী ৭৪৫ সনে) নির্মান করা হয়। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে রয়েছে কালী বাড়ি মন্দির, ফরিদগঞ্জের আউয়ালের মিষ্টি, কচুয়ার প্যারা সন্দেশ ও মতলবের ক্ষীর পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় খাবার।
সারা দেশের সাথে সড়ক, নৌ ও রেলপথে যোগাযোগের সুবিধা রয়েছে চাঁদপুর জেলার। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও চাঁদপুর বিকশিত হচ্ছে না। সড়কের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বাহনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী।
এ ব্যাপারে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, চাঁদপুর অনেক সুন্দর একটি জেলা। এখানে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক মানুষ আসে। তাছাড়া নৌ পথে যাতাযাত সহজ হওয়ায় ঢাকা থেকেও অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। তবে শহরের যানজট পর্যটকদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ডাকাতিয়া ও মেঘনা-ধনাগোধা নদীতে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বড়স্টেশন এলাকায় ভিক্ষুকদের কিছুটা আনাগোনা রয়েছে। তবে তাদের অনেকেই বহিরাগত। আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ এসব সমস্যা নিরসনে কাজ করতে চাই। যাতে করে চাঁদপুরে আরো বেশি পর্যটক আসতে পারে।
তিনি আরো বলেন, বড়স্টেশন এলাকায় নদীতে অনেক ¯্রােত থাকে। তাই সেখানে ভাসমান রেস্তোরা তৈরির ব্যাপারে আমরা এখনো তেমন কোন চিন্তা করিনি। তবে ডাকাতিয়া নদীর উপরে ক্যবলকার নির্মাণের জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করার কথা ভাবছি। চাঁদপুরের পর্যটনখ্যাত আরো বেগবান করতে শহরে থাকা লেকগুলোতে সৌন্দর্যমন্ডিত করাসহ সামগ্রিক উন্নয়ণের পরিকল্পণা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।