বৈশ্বিক মহামারি : জীবন জীবিকার অলিখিত সংবিধান

বি এম হান্নান :

১. জীবন ও জীবিকা
জীবন বা প্রাণ এমন একটি অবস্থা, যা মৃত অবস্থা থেকে পৃথক করে। খাদ্য গ্রহণ, বিপাক, বংশবৃদ্ধি, পরিচলন ইত্যাদি কর্মকান্ড জীবনের উপস্থিতি নির্দেশ করে। পক্ষান্তরে জীবিকা হচ্ছে; জীবনধারণের জন্য অবলম্বিত বৃত্তি, পেশা বা বেঁচে থাকার উপায় করা। কবির কথায়-‘জীবনের বিচিত্রিত পথে চলছে ছুটে জীবিকার ট্রাম/ ঝিনুকের হৃদমাঝে লুকানো মুক্তার মতো,/ জীবন রেখেছে ধরে মহাকালের অন্তর,/ জীবিকার অলিখিত সংবিধান।’

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর কবিতায় ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রূটি’। এ দু’টি চরনে জীবন-জীবিকার নির্মম বাস্তবতা নিহিত রয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে কোনো সৌন্দর্য প্রতিভাত হয় না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ যখন চোখে সর্ষেফুল দেখে,প্রকৃতির সব উপকরণের মধ্যে সে তখন খাদ্য দেখতে পায়। পৃথিবীটা হয়ে যায় নিরস গদ্যময়। আর তখনই দূর আকাশের চাঁদটা তার কাছে সবেমাত্র আগুনের চুলোয় সেঁকা ঝলসানো রূটি মনে হয়। রঙিন পৃথিবী তার কাছে লাগে বিবর্ণ।

জীবনের জন্য জীবিকা। জীবিকার জন্য জীবন নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ জীবন এবং জীবিকার মধ্যে এ রকম দ্ব›দ্ব মোকাবিলা করছে। তবে বিবেচনার বিষয় কোনটা আগে। জীবিকা প্রাণ বাঁচাবে? না, বেঁচে থাকলে কোনো না কোনো জীবিকা জুটবে?

২. কোভিড-১৯
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে লকডাউন বজায় রয়েছে। যদিও সরকারিভাবে এটিকে সাধারণ ছুটি হিসেবে বলা হচ্ছে। দেশের সব অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ঘরে থেকেই অধিকাশংরা অফিসের কাজ করছেন। খাদ্য ও ওষুধ কেনার মতো জরুরি পরিসেবা ছাড়া জনগণকে ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ভয়াবহ করোনাভাইরাসের দ্রুত বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা বিবেচনা করে সরকার এ নিয়েছে। যেহেতু এ রোগের এখনো প্রতিষেধক আবিস্কিত হয়নি, তাই কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমান বৈশ্বিক মহামারির এ পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত অবশ্যই মানুষের জীবন বাঁচানো। কারণ মানুষের জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই। সেই জীবন এখন করোনাভাইরাসের কারণে বিপন্ন। যতটা সম্ভব নিজেকে একা রাখা, সঙ্গ বর্জন করা, বার বার হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যাতে সংক্রমিত লোকের সাহচার্যে রোগ না ছড়ায়। এর বাইরে কারও হাতে নিরাময়ের অন্য কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা নিরাময়ের উপায় খোঁজার চেষ্টা চলছে, কিন্তু তার সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। তাই একটাই উপায়, নিজেদের আলাদা রাখা।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে আদৌ কী সম্ভব হবে। লকডাউনের সময়ে মানুষ বাইতে বের হতে পারছে না, কাজ করতে পারছে না, আয় করতে পারছে না। দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল, এমনকি স্বল্প আয়ের মাসিক বেতনভুক্ত মানুষের আয়ের পথও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮০/৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, তাই এখন তাদের হাতে কোনো টাকা নেই। ফলে সংকটকালে জীবনধারণের জন্য তাদের তেমন কিছুই হাতে থাকে না।

এদের মধ্যে দিনমজুর, গৃহকর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরিজীবী, টিউটর, হকার ঊল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া পেশাহীনদের মধ্যে ভিক্ষুক, পথশিশু, প্রতিবন্ধী, দরিদ্র স্বামী পরিত্যক্তা নারী, বিধবা এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের গরিব মানুষ অভাবের মধ্যে দিন যাপন করছে।

মধ্যবৃত্তের মধ্যে কেউবা বাড়ি ভাড়া থেকে সংসার চালান। অনেকে নানা ধরনের সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মুনাফায় সংসার চালান। তারা সে টাকা তুলতে পারছেন না। অনেকেই ব্যাংক থেকেও টাকা তুলতে পারছেন না নানা কারণে। আবার এদের প্রায় সবাই সরকারি সাহায্য থেকে বঞ্চিত। তারা না পাচ্ছেন সাহায্য, না পারছেন সাহায্য বা ভিক্ষা চাইতে।

৩. পদক্ষেপ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান বলেন, ‘মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি সরকারকে মানুষের জীবিকাকেও রক্ষা করতে হয়। সেই কারণে জীবন ও জীবিকা দুটোই রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষকে ত্রাণের আওতায় আনা হয়েছে। বিগত দুই মাস লকডাউন থাকলেও কেউ না খেয়ে মারা যায়নি।

সরকারের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বিত্তশালী, সমাজসেবক সবাই এগিয়ে এসেছে। এটা আমাদের সংস্কৃতি।’ গত ৭ মে-২০২০ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা, ত্রাণ কার্যক্রম, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে করণীয় নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় সভায় এ সব কথা বলেন তাঁরা।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা সরবরাহ করা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রথমত, এটি দিয়ে তারা তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য সরবরাহ করতে গেলে অনেক নিয়ম ভাঙার খবর থাকে, স্বচ্ছতার অভাব থাকে। তৃতীয়ত, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি নগদ অর্থ দিলে দুর্নীতির সুযোগ কম থাকে। কিন্তু চাল ও অন্যান্য পণ্যের অনিয়ম বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চতুর্থত, সরাসরি নগদ স্থানান্তরের জন্য লোক জড়ো হওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং কোভিড-১৯এর সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হবে। পঞ্চমত, নগদ অর্থ সহায়তা অর্থনীতির ওপর গুণক প্রভাব তৈরি করে। অর্থাৎ এই অর্থ দিয়ে চাল-ডালের বাইরে অন্যান্য পণ্য কেনার মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে, যেটি এই মুহুর্তে খুব দরকার। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়, এই নগদ স্থানান্তর প্রক্রিয়া কমপক্ষে তিন মাসের জন্য হওয়া উচিত।’

করোনা থেকে জীবন বাঁচানোর এই সংগ্রাম শেষ হলে অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে মানুষজনকে তাদের কাজে ফেরানো, স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়ায়। এ বিষয়ে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলোর আলাপচারিতা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ইতিমধ্যে মানুষের জীবন আর জীবিকায় একটা সংঘাত হচ্ছে। এ মুহূর্তে কৌশলকে আরও সূচারু করতে হবে। রোগের প্রধান কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করা এর শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে।’

৪. পাদটীকা
বৈশ্বিক মহামারিতে জীবন-জীবিকার মুল্যবোধ নিয়ে যেখানে সংশয়, সেখানে এক শ্রেণীর মানুষ হামলে পড়েছে জিনিস মজুদ করতে। সাধারণ ভোক্তাদের কথা চিন্তা না করে পকেট উজাড় করে কেনাকাটা করছে। দোকান খালি করে জিনিস কিনে ঘর ভরেছে। তাদের ভোগ-বিলাসের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে একা বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা বাদ দিয়ে সবার আগে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। কেননা জীবন আগে, জীবিকা পরে। সবার মাঝে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

লেখক: সাংবাদিক ও নাট্যজন
bmhannan73@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)