মফস্বল সাংবাদিকতায় করোনার প্রভাব

—————-রহিম বাদশা—————–

বৈশ্বিক মহামারি করোনা বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতায় বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে। এই দুর্যোগে একদিকে যেমন সাংবাদিকতার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে। সাংবাদিকতায় অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় নতুন নতুন সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের। সব মিলিয়ে মফস্বল সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে করোনাকালে। ফলে করোনা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতা নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

করোনাকালে মফস্বল সাংবাদিকদের চিরসঙ্গীঅর্থনৈতিক সংকট যেমন তীব্রতর হয়েছে, তেমনই স্বাস্থ্যঝুঁকি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। স্মরণকালের মহাসংকটে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়েছে জেলা-উপজেলা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে সংবাদ জানার আগ্রহ ও চাহিদা বেড়েছে। গ্রামের একেবারে নিভৃত পল্লি কিংবা দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষটি এখন সবার আগে সর্বশেষ খবরটি পেতে চায়। বিশেষ করে নিজ এলাকা থেকে শুরু করে সারাদেশ এমনকি বিশ্বের সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি জানতে সবাই উদ্গ্রীব। মানুষের এই চাহিদা মাথায় রেখেই ‘সব কাজের কাজি’ খ্যাত মফস্বল সাংবাদিকদের প্রধান বিটে পরিণত হয়েছে ‘করোনা আপডেট’।

কোথায় কে করোনায় আক্রান্ত হলো, কে আক্রান্ত অবস্থায় বা উপসর্গে মারা গেল, উপসর্গে মৃতের নমুনা সংগ্রহ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন করা হয়েছে কি না- এসবের খবর রাখতে হয় নিত্যদিন। পাশাপাশি উপসর্গে মৃতদের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট কী, আক্রান্ত/মৃতদের বাসাবাড়ি লকডাউন হলো কি না, উপজেলা-জেলাভিত্তিক দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নেওয়া, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী/স্থানীয়দের বক্তব্য নিয়ে নিজ নিজ গণমাধ্যমের ধরন অনুযায়ী রিপোর্ট তৈরি এবং পাঠাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও কর্মকর্তা সরাসরি সাক্ষাৎ/বক্তব্য দিতে আপত্তি জানান। টেলিফোন বা মোবাইল ফোনেও সাড়া দেন না কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি।

করোনার এই বাড়তি দায়িত্বের পাশাপাশি প্রাত্যহিক ঘটনা-দুর্ঘটনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজের নানা বিষয়ে খোঁজ রাখতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই সময়ে বড়ো ধরনের সভা-সমাবেশ-রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ থাকলেও মফস্বল সাংবাদিকদের ব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণে। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে করোনাকালে মফস্বল সাংবাদিকদের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যাতায়াত ও যোগাযোগ। দীর্ঘদিন গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় মফস্বল সাংবাদিকদের জেলাব্যাপী যাতায়াতে বড়ো ধরনের প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল।

বর্তমানে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হলেও গণপরিবহণে চলাচল করতে গিয়ে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিতে হচ্ছে। সহকর্মীর মোটরবাইকে সঙ্গী হলে অথবা নিজের মোটরবাইকে অন্য সহকর্মীকে সঙ্গে নিলেও একই ধরনের ঝুঁকি বিদ্যমান। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় রোজ উন্নতমানের নিরাপত্তাসামগ্রী (পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস) ব্যবহারের সামর্থ্য নেই অধিকাংশ মফস্বল সাংবাদিকের। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে কিংবা নিজের খামখেয়ালিপনায় অনেকে একই সুরক্ষাসামগ্রী দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে চলেছেন।

সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থল অথবা কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া সাংবাদিকদের প্রধান কাজ। করোনাকালে এতে বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছে করোনার নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও চিকিৎসা দেওয়া হয় এমন অতিঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া। এসব হাসপাতালে করোনা সংক্রমণের তীব্র ঝুঁকি জেনেও মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতিদিন এক বা একাধিকবার সেখানে ছুটে যেতে হয়। এছাড়া ত্রাণ বিতরণ, দুর্ঘটনাস্থল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন, থানা
প্রভৃতি জনবহুল স্থানে পেশাগত কারণে সাংবাদিকদের ছুটতে হয় করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি জেনেই।

কখনো কখনো ভালো সংবাদ, ছবি, ভিডিয়ো ফুটেজের প্রয়োজনে করোনা আর স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি ভুলে যান অনেক সংবাদকর্মী। বলতে গেলে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতোই স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে সমানতালে কাজ করছেন মফস্বল সাংবাদিকরা। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মফস্বল সাংবাদিক করোনায়
আক্রান্ত হয়েছেন ইতোমধ্যে। বৈচিত্র্যপূর্ণ এত অধিকসংখ্যক বিটে এতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় না ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদেরও। সেই তুলনায় প্রাপ্তি ও স্বীকৃতি দুটোতেই উপেক্ষিত মফস্বল সাংবাদিকরা।

করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিতে মফস্বল সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ, ভোগান্তি, সমস্যায় পড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকটে। এমনিতেই মফস্বলের অধিকাংশ সাংবাদিক কর্মক্ষেত্র, পরিশ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে খুব সামান্য অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের কমিশন অধিকাংশ সাংবাদিকের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে উভয় ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের বাজার একেবারে সংকুচিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণের সম্মানিও প্রায় বন্ধ হয়েছে করোনা পরিস্থিতির কারণে।

সার্বিকভাবে কাজের পরিধি ও ঝুঁকি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলেও আর্থিক সুবিধা মোটেও বাড়েনি। বরং করোনা পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে কিংবা করোনার অজুহাতে অনেক জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমও জেলাউপজেলার সাংবাদিকদের সম্মানি কমিয়ে দিয়েছে কিংবা বন্ধ করে দিয়েছে, যা মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে মফস্বলের অনেক সাংবাদিককে পেশা ছেড়ে দিতে হতে পারে। আর পণ করে সাংবাদিকতায় থেকে যাওয়াদের দুর্দশা, দুর্ভোগ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনাকালে সঠিক তথ্য দিয়ে গুজব প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা রাখছেন মফস্বলের সাংবাদিকরা। অথচ এসব সাংবাদিকের পাশে নেই মানবকল্যাণ-সমাজকল্যাণ-জনসেবার নামধারী কোনো ব্যক্তি-সংগঠন। নেই স্থানীয়-জাতীয়-আন্তর্জাতিক দাতা কিংবা সাহায্য সংস্থা। এ পর্যন্ত কালের একমাত্র প্রাপ্তি বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত এককালীন ১০ হাজার টাকা অনুদান।

এমন বাস্তবতায় করোনার মতো বৈশ্বিক দুর্যোগে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে তথ্য, ছবি, ফুটেজ আদানপ্রদান ব্যাপকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এতে ঝুঁকি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে আসবে। অকুস্থলে যাওয়ার পরিবর্তে টেলিফোন, মোবাইল, অ্যাপের ব্যবহারও ঝুঁকি ব্যাপকভাবে কমাতে পারে। ফাইল ছবি, ফুটেজের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে। বিশেষ প্রয়োজনে অডিয়ো-ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন অনেকে। অধিকাংশ পত্রিকা, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষও এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ছাড় দিচ্ছেন এখন।

সাংবাদিকদের অপ্রয়োজনে ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতাও কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেউ আক্রান্ত হলে তার গোটা পরিবারটিও ভুক্তভোগী হবে নানাভাবে। আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়বে তাদেরও। এছাড়া অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপায় খুঁজতে হবে। সাংবাদিক নেতাদের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজ নিজ গণমাধ্যম থেকে বেতন/সম্মানি আদায় নিশ্চিত হলেই এই সংকট অনেকটা কেটে যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকারি প্রণোদনা দফায় দফায় অব্যাহত রেখেও এর সমাধান করা যেতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধযোগ্য ঋণের আওতায়ও আনা যেতে পারে সাংবাদিকদের।

মফস্বল সাংবাদিকদের মতোই জেলা-উপজেলা থেকে প্রকাশিত মফস্বলের দৈনিক/সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর এখন চরম ক্রান্তিকাল চলছে। করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সব পত্রিকার কমবেশি প্রচারসংখ্যা কমেছে। অস্বাভাবিক হারে কমেছে বিজ্ঞাপন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের সীমাবদ্ধ দান-অনুদানও বন্ধ প্রায়। স্মরণকালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে টিকে থাকতে না পেরে কিছু পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গেছে। অনিয়মিত হয়ে গেছে অনেক পত্রিকার প্রকাশনা। যারা এখনও নিয়মিত প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন, তারাও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তবে সরকারি বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল পরিশোধের বিশেষ উদ্যোগ পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। করোনাকাল ও করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত মফস্বলের পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। করোনাবিষয়ক সরকারের বিভিন্ন প্রচারের বিজ্ঞাপন স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় দেওয়া হলে সরকার ও গণমাধ্যম উভয়পক্ষই উপকৃত হতে পারে। পত্রিকাগুলোকে বিনা সুদে কিংবা স্বল্পসুদে ঋণ দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতে পাারে। মনে রাখা দরকার, এমন দুর্যোগে গণমাধ্যম সচল না থাকলে সৃষ্ট গুজবে বহু লঙ্কাকান্ড ঘটে যেতে পারে।

করোনা পরিস্থিতি অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও সাংবাদিকদের পেশাগত অনেক উৎকর্ষতার সুযোগও এনে দিয়েছে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে প্রায় শতভাগ মফস্বল সাংবাদিক এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের আওতায় এসে গেছেন। অনেকে সর্বশেষ প্রযুক্তির ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি সাংবাদিকদের পেশাগতভাবে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। বেড়েছে গণমাধ্যমের গুরুত্ব, চাহিদা ও বিস্তৃতি। অবাধ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচারিতা ও অপপ্রচার থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে চলেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ছাপা পত্রিকার ক্রান্তিকালের বিপরীতে পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন এবং অনলাইন গণমাধ্যমের তাৎক্ষণিক খবর জানার চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু সেখানেও প্রধান সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে আয়ের খাত সংকুচিত হওয়া। অনলাইনেও বিজ্ঞাপন কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। পাশাপাশি বেশুমার অনুনোমোদিত অনিয়ন্ত্রিত ও ভুঁইফোঁড় অনলাইনের অপসাংবাদিকতা মফস্বলের পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। হুমকিতে ফেলেছে মফস্বলের সংবাদপত্র শিল্পকেও। এসবের লাগাম টানার এখনই সময়। এমন বাস্তবতায় করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতায় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মিলিত প্রয়াস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে।

-লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ।

(পিআইবি’র গণমাধ্যম সাময়িকী ‘নিরীক্ষা’র ‘করোনাকালে সাংবাদিকতা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক সংখ্যায় প্রকাশিত।)

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন