মা বিহীন ঈদ

-মোঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয় :

মা
চলে গেলে কেমন নিঃশব্দে
রোগ নেই, ব্যথাতুর নও
তবু আচমকা এতটা দূর

তোমার আঁচল পাবো বলে
এই মরুর প্রান্তর থেকে
বারবার ছুটে গেছি মা
প্রিয় সান্নিধ্যে

আজ ঘুমহারা চোখ
যেদিকে দেখি তোমার হাসিমুখ
ডেকে যাচ্ছো পরম স্নেহে!

রোজ ভাবী
কান্নায় ভেসে যায় চোখ
বাবা তো দূরের যাত্রী
তুমিও নেই
আমাকে কুরে কুরে খায় শূন্যতা
তোমার রেখে যাওয়া আদর।

প্রিয় পাঠক মায়ের আঁচল তলে থেকেই, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা নিয়েই জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি, শিশুকাল থেকেই ভেবেছি একদিন যখন প্রতিষ্ঠিত হব তখন মায়ের সকল কস্ট গুলি আমার নিজের মাঝে নিয়ে মায়ের হাতে এনে দিবো একমুঠো স্বপ্নময় সুখ।

মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে তার কিছুটা স্বপ্ন পূর্ণ করে দিতে পেরেছি, আর বাকি ছিলো কিছুটা স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। পৃথিবীর সকল মায়া মমতা ত্যাগ করে আমাদের এতিম করে গত ১০ মে ২০২০ ফজরের নামাজের সময় মা ফিরোজা বেগম চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

দূর প্রবাসে বসে আমার মমতাময়ী মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়েছে, মহামারী করোনার কারনে দেশে যেতে পারিনি, চাঁদপুর শাহরাস্তি পৌরসভাস্থ ১১নং ওয়ার্ড কৃষ্ণপুর নিজ গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে বাবার পাশেই কবরস্থ করা হয়েছে।

জানাজা হওয়ার আগে আমার বড় ভাই আবদুল জলিল মানিক, অ্যাডভোকেট এম এস আলম ভাই ভিডিও কলের মাধ্যমে মায়ের ছবি দেখিয়েছেন, মাকে দেখে মনে হচ্ছে মা আমার ঘুমিয়ে আছেন, মুখখানায় সুন্দরের আলো জ্বলে ফুটেছে। দু’চোখের পানি গড়িয়ে গায়ের জামা ভিজে শুকিয়ে গেছে।

গত ২০১৯ সালের ঈদুল আজহার সময় প্রবাস থেকে ফিরে মায়ের সাথে ঈদ করেছি, কোরবানির গরু কিনে বাড়ি ফিরতেই মা বল্লেন বাবা এই দিকে আয় গরমে এ কি হাল হয়েছে নে লেবুর সরবত খেয়েনে, চেহারা লাল হয়ে গেছে, তারপর মা নিজে গরু দেখে বেশ খুশি। আর শুধু বলছেন তুই বাড়ি থাকলে আমার অনেক ভালো লাগে বাবা, আগামি ঈদেও বাড়ি আসবি মা, ছেলে একসাথে ঈদ করবো।

ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে মাকে সালাম করতেই মা বল্লেন ঈদের সালামি কই,আমি বল্লাম তুমি দিবে আমায়, মা বল্লেন তুমি এখন বড় হয়েছো এখন তুমি দিবে, আর দেরি না করে মাকে জড়িয়ে ধরে ঈদের সালামি দিলাম।
ঈদ শেষে মায়ের সাথে অনেক দিন বাড়ি ছিলাম, ভাইদের সাথে শহরে যেতে হবে বিদায় মা বলতেন তুই যতদিন বাড়ি থাকবি আমি শহরে যাবোনা, গ্রামেই থাকবো, শহরের চার দেয়ালের মাঝে ভালো লাগেনা, আশে পাশের লোকদের সাথে কথা বলা যায়না, যে যার মতো করে ঘরে বসে থাকে, এ কেমন শহর।

বল্লাম ঠিক আছে মা আমি প্রবাসে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি আমার সাথেই থাকো,মা অনেক খুশি, মায়ের পছন্দ ছিলো নানান ধরনের ছোট মাছ, বাজারা যাওয়া মাত্রই যত ধরনের মাছ পেতাম কিনে নিয়ে আসতাম, আর মাছ দেখেই মা ভাই, বোনদের কল দিয়ে বলতেন আজ আমার সাংবাদিক ছেলে অনেক মাছ এনেছে, তোদের জন্য ফ্রিজে রেখে দিবো।

আজ আবার বছর ঘুরে ঈদ এসেছে নেই শুধু আমার মা, আমার জন্য নামাজ আদায় করেই দোয়া করতেন, প্রবাস থেকে কল দিলেই বলতো বাবা তোমাকে আল্লাহ সুখে রাখুন, সুস্থ রাখুন, আল্লাহ আমার হায়াত তোমাকে দান করুন, যে সুখে তুমি ও তোমরা আমায় রেখেছো।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি তোমাদের মতো সন্তান আমায় দিয়েছেন। এই কথা গুলি আর শুনতে পাবোনা , মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি তিনি আমার মা, বাবা কে জান্নাতবাসী করুন। মা বিহীন ঈদ ভাবতে ই বুক ফাটা কান্না আসে।

মায়ের অবদান লিখে শেষ করা যাবেনা।
দুনিয়া সৃষ্টি থেকে আজব্দি একটি কথা চীর মূল্যবান মা, আর তার সাথে মায়ের ভাই আমাদের সম্পর্কে হয় মামা, আর মামা শব্দ লিখতে মা+মা = মামা যোগ হয়েছে। তাইলে বুঝে নিতে হবে মা শব্দের যেমন ব্যাপকতা, তেমনি মামা শব্দের ব্যাপকতা হবার কথা থাকলেও তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা শুধুই মা। সন্তানের সুখে, দুঃখে সবাই ছেড়ে গেলেও মা যায়না, যায়নি, যাবেনা কারণ নাড়ির ছেড়া ধন তার সন্তান, দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখেছেন।

মাকে নিয়ে অনেক উপমা রয়েছে, মৃত্যু কালেও যে মা তার জীবন দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করেছেন তার কিছু উদাহরণ পড়ে দেখুন। যেমন-
মাকড়সার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। শত শত ক্ষুদে বাচ্চা।
ক্ষুদার্থ বাচ্চাগুলোর পৃথিবীতে আসার পরই খাদ্যের
দরকার হয় কিন্তু মা মাকড়সা বাচ্চাদের ছেড়ে খাবার
আনতে যেতে পারেনা এই ভয়ে যে কেউ এসে বাচ্চার
কোন ক্ষতি যদি করে। নিরুপায় মা মাকড়সা শেষমেশ
নিজ দেহটাকে বাচ্চাদের খাদ্য বানায়। বাচ্চারা খুটে
খুটে মায়ের দেহ খেয়ে একসময় চলে যায় যার যার পথে।
পেছনে পড়ে থাকে মায়ের শরীরের খোলস। একেই বলে মা….

জাপানের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময়ের কথা।
উদ্ধারকর্মীরা একটি ভেঙ্গে পড়া বাড়ির ধ্বংসস্তুপ
থেকে জীবিত কাউকে উদ্ধারের আশায় এসেছে। এ সময়
বাড়িটির ভেতরে একটা ভেঙ্গে পড়া থামের নীচে এক
মহিলার মৃতদেহ দেখতে পায় তারা। মহিলাটির পিঠের
উপর সিমেন্টের থাম পড়েছে। মহিলাটি হাটু গেরে
মাটিতে উবু হয়ে বসে আছেন। যেন থামের আঘাত থেকে
কিছুকে আড়াল করে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন মহিলা।
রেসকিউ টিম থাম কেটে মহিলার মৃতদেহ উপর করলে
ভেতরে পাওয়া যায় এক বছর বয়সী এক বাচ্চা। ফুটফুটে
বাচ্চা। মা সন্তান কে রক্ষার জন্য এভাবেই সন্তানকে
ঢেকে উবু হয়ে রয়েছিলেন যাতে থাম ভেঙ্গে মায়ের
পিঠে পড়ে। সন্তান যাতে তবুও বাঁচে। মা শুধুই মা।

কমলাপুর রেলস্টেশনের শীতের রাতের একটি ঘটনা।
খুব শীত পড়েছিল। বৃদ্ধা মা ছেলেকে নিয়ে থাকে
প্ল্যাটফর্মে। এত দরিদ্র যে শীতে গায়ে দেয়ার কাথা
মাত্র একটা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধা। প্রতিদিনের
মত ছেলে কাজ সেরে এসে মায়ের গায়ে কাথা টা টেনে
দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। মাঝ রাতে মা উঠে দেখলেন শীতে ঠক ঠক করে সন্তান কাপতেসে। সন্তানের গায়ে কাথা দিয়ে, মা শুয়ে পড়লেন, প্রচন্ডরকম শীত। সকালে সন্তান ঘুম থেকে উঠে দেখলেন মা আর বেচে নেই। এরি নাম মা। মায়ের হাজারো কস্ট হলেও সন্তানের কষ্ট কোন মা চায়না।

মাঝে মাঝে চিন্তা করি মা শব্দটার ডেফিনেশন কি। খেই
হারিয়ে ফেলি। পাতালের তলায় পৌছান যাবে, দূরের
গ্যালাক্সি ভ্রমন করা যাবে কিন্তু মা নামক মানুষটার
ভালোবাসার কোন কূল পাওয়া যাবেনা। মায়েদের
ভালোবাসা পরিমাপ করার মত কোন ব্যারোমিটার এই
পৃথিবীতে নেই। মায়ের বিকল্প আর কেউ হতে পারেনা, মা শুধুই মা, সে মাকে অবহেলিত অবস্থায় রেখে সুখি হওয়া যায়না। দুনিয়া ও আখেরাত পেতে চাইলে মায়ের সেবা করুন, বাবার সেবা করুন।

মহান আল্লাহ আমার বাবা, মাকে জান্নাতবাসী করুন আমিন

লেখক পরিচিতি : প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক, নাট্যকার, মানবাধিকার কর্মী।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন