মুজিববর্ষে জাতীয় পর্যায়ে সেরা করদাতা চাঁদপুরের হাজী মো. কাউছ মিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক :
মুজিববর্ষে সেরা করদাতার সম্মাননা গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও চাঁদপুরের কৃতি সন্তান দানবীর হাজী মো. কাউছ মিয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে জাতীয় রাজস্ব খাতের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড সিআইপি মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে রাজধানীর রাজস্ব বোর্ডের সম্মেলনকক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাকে সেরা করদাতার বিরল সম্মাননা প্রদান করে।

অনুষ্ঠানে হাজী মো. কাউছ মিয়ার হাতে সম্মাননা স্মারক, ক্রেস্ট ও মানপত্র তুলে দেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মে. রহমাতুল মুনিম। এ সময় বোর্ডের অন্যান্য কর্মকর্তারা এবং দেশের সকল পর্যায়ের গণমাধ্যম প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

এ পুরস্কার সম্পর্কে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আমরা চেয়েছিলাম মুজিববর্ষে দেশের বিশিষ্ট করদাতাদের সম্মান জানাতে। সেখান থেকেই আমরা একজনকে বেছে নেই। হাজী মো. কাউছ মিয়া দীর্ঘদিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কর দেওয়াকে নিজের দায়িত্ববোধ মনে করেন।
মুজিব বর্ষের সেরা করদাতা অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে হাজী মো. কাউছ মিয়া বলেন, রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছে। তিনি বলেন, একাত্তরের সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ভালোবেসে ছিলেন।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিরাপত্তার জন্যে একটি রিভলবার লাইসেন্স প্রদান করেন, যার নং ১৪। ওই সময় দেশের যে পরিস্থিতি ছিল তখন তার সেই রিভলবারটি খুবই দরকার ছিল। বয়সের কারণে সেটি তিনি নিজের ইচ্ছায় ২০১৮ সালে বংশাল থানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জমা দেন। এখন তার শতবর্ষে এসে এ পুরস্কার তার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। তাতে তিনি অনেক খুশি ও আনন্দিত। দেশকে ভালোবেসে দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে নিজ দায়িত্ববোধ থেকে কর দিয়ে আসছেন তিনি।

হাজী মো. কাউছ মিয়া তার এই স্বীকৃতির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ডক্টর মশিউর রহমান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রাহমাতুল মুনিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
দেশে কত বড় বড় বিত্তশালী, প্রভাবশালী, হাইপ্রোফাইল করপোরেট ব্যবসায়ী রয়েছেন, তাদের ভিড় ঠেলে বাংলাদেশ সরকার পুরাণ ঢাকার হাকিমপুরী জর্দার ব্যবসায়ী হাজী মো. কাউছ মিয়াকে মুজিববর্ষেও সেরা করদাতা নির্বাচিত করেন।

ক’দিন আগেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছর ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে দেশসেরা করদাতার ১ নাম্বার মনোনীত হয়ে ট্যাক্স কার্ড ও সম্মাননা পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরে এ নিয়ে তিনি ১৮ বার সিআইপি মর্যাদার দেশসেরা করদাতার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনের রেকর্ড গড়েন। এবার তার সাথে যুক্ত হলো মুজিববর্ষের সেরা করদাতার স্বীকৃতি।

গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বার নেই হাজী মো. কাউছ মিয়ার। পুরাণ ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডে হাকিমপুরী জর্দার কারখানার একটি কক্ষই তার ‘চেম্বার’। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তার কারখানা। সেখানেই বসেন তিনি। গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরাণ ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতি বছর সর্বোচ্চ করদাতা হন। প্রতিবারই শীর্ষ করদাতাদের তালিকায় তার নাম থাকছে সবার উপরে। অবশ্য অন্য শ্রেণীর ব্যবসায়ীগণ প্রতিবছর সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টাকার কর দেন, কাউছ মিয়ার ধারে কাছেও নেই তারা।

কাউছ মিয়া ৬১ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। কেন কর দেওয়া শুরু করলেন, এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে টাকা-পয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকতো। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ফ্রি হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকা-পয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।’

১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া। তার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। অথচ ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। পুরাণবাজার মধু বাবুর স্কুলে পড়েছেন তিনি। ওই স্কুলের পাশেই তাঁর নানা জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম সাহেবের বাড়ি।

কাউছ মিয়া তার বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারী দোকান দেন। ওই সময় দেশের প্রসিদ্ধ এই বাণিজ্যিক এলাকায় তৎকালীন তার ৬টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন তিনি। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকসহ অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেন। ৪০ থেকে ৪২ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত (তৎকালীনসহ বিভিন্ন সময়ে)।

একবার তিনি আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল, এটা চিন্তা করে আমদানির ব্যবসা করেন নাই। নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্যে বেশ কিছু কার্গো জাহাজ রয়েছে কাউছ মিয়ার। জাহাজগুলো ছেলেদের নামে দিয়ে দিয়েছেন। তারাই এই ব্যবসা দেখাশোনা করছে।
১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট কাউছ মিয়া চাঁদপুরে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। হাজী মো. কাউছ মিয়ার বড় বাবার নাম হাজী মো. মুসলিম মিয়া বেপারী, দাদার নাম হাজী মো. সবদ আলী মিয়া বেপারী (সবদ হাজী)। পিতার নাম হাজী মোঃ আব্বাস আলী মিয়া বেপারী ও মাতা জমিদার কন্যা মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। তারা কেউ বেঁচে নেই।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)