অনৈতিহাসিক : বঙ্গবন্ধুর রেনু আমাদের বঙ্গমাতা ।। বিশ্ববিদ্যালয় চাই


মুহম্মদ শফিকুর রহমান :
বঙ্গবন্ধুর রেনু আমাদের বঙ্গমাতা। বেগম শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব। পোশাকে আশাকে সাধারণ নারী হলেও ব্যক্তিত্বে প্রজ্ঞায় ধীশক্তিতে অসাধারণ হয়ে ওঠেছিলেন। আমি মনে করি আগামীর কন্যাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি। যে কন্যা সন্তানটি তাতে ভর্তি হবে দেখবে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তার মনোজগতে তখনি জন্ম নেবে একজন মহিয়সী নারীর প্রতিচ্ছবি। সে ছবি সারাজীবন তাকে পথ দেখাবে। আগামীর সোনালী পথে।

বেগম শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিব, যে নাম উচ্চারণের সাথে সাথে সামনে এসে দাঁড়ান মাতৃরূপেন এক মমতাময়ী নারী যিনি জাতির পিতার সহধর্মিনী হিসেবে সংসার ধর্ম পালন করেই বসে থাকেননি, কোথায় দলের কি লাগবে (বঙ্গবন্ধুতো বলা যায় জীবনটাই জেলে জেলে কাটিয়েছেন) দলের কোথায় দল পেছনে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে হবে। বিরাট বড় লোকের ঘরের বউ ছিলেন না আবার অভাবের সংসারেরও ছিলেন্না। তবে ছিলেন বাংলার এক বনেদি পরিবারের একজন।ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে শুনেছি তিনি তার সোনার গয়না বিক্রি করে ছাত্রলীগকে দিয়েছিলেন। তাকে আমরা কল্পনা করতে পারি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত রূপে-ভুল হবেনা; তাকে আমরা কল্পনা করতে পারি জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল রূপে- ভুল হবেনা, আমরা তাকে কল্পনা করতে পারি প্রীতিলতা ওয়ালেদার রূপে- ভুল হবে না। ভুল হবেনা মোটেও।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের এই মায়ের বুকটিও ঝাঝরা করে দিয়েছিল জিয়া-মুশতাকের ঘাতক বুলেট। বঙ্গবন্ধুর সাথে বুকের ধন মানিকদের নিয়ে একসঙ্গে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বেঁচে থাকলে আজ ৯০ বছর পার করে ৯১-তে পা রাখতেন। আসুন আমরা দোয়া করি আল্লাহ পাক যেন তাঁর কবরকে বেহেশতের দরজা বানিয়ে দেন। আমিন।

বঙ্গমাতার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। হাজার নদী বাংলাদেশের অন্যতম মধুমতি আর শাখা বাইসার নদীর মাঝখানে স্নিগ্ধ সবুজ টুঙ্গিপাড়ার বনেদি শেখ বাড়িতে। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বাবা-মা দুজনকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান। তিন বছর বয়সে বাবা জহুরুল হক ইন্তেকাল করেন এবং ৫ বছর বয়সে মাকে। তখন দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনিকে চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বিয়ে দেন।

এ লেখা যখন লিখতে বসেছি তখন ৫ই আগস্ট। অনুজ প্রতিম সহকর্মী দুলাল আচার্য জানালেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ ছেলে শেখ কামালের জন্মদিন আজ অর্থাৎ ৫ ই আগস্ট। মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ নাটকের অভিনেতা ফুটবলার এবং আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা, সেতার বাজাতেন এবং স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীরও প্রতিষ্ঠাতা, কি-না ছাত্রনেতা, যুবনেতা। সাথে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। কিন্তু কোনদিন তা শো করেননি বরং সাদামাটা জীবনযাপন করতেন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এগুলোকেই পুঁজি করেছিলেন। আজ মনে পড়ে অনেক কথা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসবেন। তখন ইত্তেফাক এর রিপোর্টার। আমার নিউজ এন্ড এক্সিকিউটিভ এডিটর আসফ-উদ-দৌলা রেজা ভাই ডেকে নির্দেশ দিলেন বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আগের দিন কি ধরনের সাজ প্রস্তুতি চলছে তার ওপর একটা রাউন্ড-আপ লিখতে। আমার একটা অভ্যাস ছিল টেলিফোনের উপর নির্ভর করে কোন নিউজ করতামনা। সব সময় স্পোর্ট কাভারেজ করতাম। সেদিনও রাত বারোটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলাম ভালোই লাগছিল।

নিজেরইতো ক্যাম্পাস মাত্র ক’দিন আগে ক্যাম্পাস ছেড়েছি। দেখলাম শেখ কামাল তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে ম হামিদসহ ক্যাম্পাস সাজামোয় ব্যস্ত। কাছে গেলে বলল কেমন হবে শফিক ভাই? বললাম তুমি আর ম হামিদ যেখানে সেখানে খারাপ কিছু হবার কোন সুযোগ নাই। মনে পরে পিতার মতোই পাতলা শরীর মোটা গোপ, মোটা ফ্রেমের চশমা, পার্থক্য শুধু পিতা পড়তেন পাজামা পাঞ্জাবি আর কামাল পরতো প্যান্ট-শার্ট তবে কখনো ইন করতনা, পায়ে থাকতো সেন্ডেল। সম্ভবত রাত বারোটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলাম। তারপর অফিসে যেয়ে শেষ প্যারাটা লিখে জমা দিয়ে বাসায় চলে গেলাম। কিন্তু আমার সেই রিপোর্ট ছাপা হয়নি অর্থাৎ কাগজই বের হয়নি। ক্যাম্পাসে থেকে বেরোবার চার ঘণ্টা পরেই সব শেষ। জিয়া-মুশতাক এতই নির্দয় নিষ্ঠুর ছিল যে শিশু শেখ রাসেল কেও বাঁচতে দিলেননা। বাঁচতে দিলেননা কামাল জামালের নবপরিণীতা বধূ দেরও যাদের হাতের মেহেদী রঙ তখন শুকোয়নি। কেবল দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানি সফরে ছিলেন তাই বেঁচে যান।

গুগল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বঙ্গমাতার রেনু নামটি দিয়েছিলেন তার মা হোসনে আরা বেগম। তার গায়ের রং ছিল ফুলের মত তাই মা তাকে রেনু বলে ডাকতেন। পরে এনাম বাড়ির সবার মুখে। বঙ্গবন্ধু সব সময় রেনু নামে ডাকতেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি অধিকারী ছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তাকে জীবন্ত ডায়েরী বলেও ডাকতেন। বাবা মার মৃত্যুর পর শাশুরি (বঙ্গবন্ধুর মা) তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং পরম মমতায় পালন করেন। শিশুবেলা থেকেই ভীষন মেধাবী ছিলেন। গোপালগঞ্জে মিশন হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভ পাশ করার পর আর স্কুলে যাননি। এরপর থেকে গৃহ শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন। সাহিত্যে তার অনুরাগ ছিল প্রবল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর প্রিয় সাহিত্যকার। প্রায়ই নিউমার্কেট বইপাড়ায় যেতেন এবং পছন্দের বই কিনে নিয়ে আসতেন।

৪৫ বছর পর আজো যখন ভাবি কত বড় ইবলিসি কলিজা ঐ খুনি জিয়া-মুস্তাকদের একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে মেরে ফেলল আর আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা ঘরেই বসে থাকলাম বড়জোর রাজপথে মানিনা মানবোনা স্লোগান দিয়েছি। একটা পাথরও ছুড়িনি ঐ খুনিদের লক্ষ করে। অথচ আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক শুধু নয় নই শেখ হাসিনার কর্মী। লম্বা লম্বা গলায় উচ্চারণ করি আখের গোছাই। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেই। আমাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সাড়ে দুইশ পাকি সেনা আর সাড়ে তিনশ রাজাকার মেরেছি বলে আওয়ামী লীগ অফিসে বসে বোল ছাড়ি। কিন্তু রাসেলের খুনিদের লক্ষ্য করে একটাও তীর ছুড়িনি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সামনে যেতে এতটুকু লজ্জা পাইনা।এজন্যই আজ দাবি উঠেছে যারা গুলি চালিয়েছিল তাদের বিচার হয়েছে পেছনের কুশীলব বা রাজনৈতিক শয়তানদের বিচার হয়নি। তাই একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করা দরকার।

বাংলার নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণ আন্দোলনের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত আন্দোলন করেছেন সমাজের একটি পশ্চাদপদ শ্রেণীর উন্নয়নের জন্য। কিন্তু আমাদের বঙ্গমাতা নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর পশ্চাদপতাকে তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার আন্দোলন করেছেন স্বামীর সাথে। কিন্তু কখনো সামনে আসেননি। কখনো কখনো ঐ মহাপুরুষকে পথও দেখিয়েছেন। একটি ঘটনা অনেকেরই জানা। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ক্যান্টনমেন্টে বন্দি।পাকি সামরিক সরকার প্রস্তাব করলেন আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে যাবেন প্যারোলে মুক্তি দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ নরম স্বভাবের মানুষটিও ক্ষেপে গিয়ে বললেন কোনভাবেই প্যারোলে মুক্তি নেয়া যাবেনা। আলোচনা করতে হলে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। অগ্রজদের কাছে শুনেছি এমন কথাও নাকি বঙ্গমাতা বলেছেন প্যারোলে মুক্তি নিলে আর কোনদিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে পারবেনা এ কথা জানিয়ে দেবেন।

আগেই বলেছি বঙ্গমাতার জন্ম হাজার নদী বাংলাদেশের এক নদী মধুমতি আর আরেক শাখা নদী বাইসার নদীর উর্বর পানীতে গড়ে ওঠা স্নিগ্ধ শ্যামল টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। তার জীবনও তেমনি গড়ে তুলেছেন গ্রামীন এক অভিজাত মাতা-ভগ্নি জায়া রূপে। কোন রকম নাগরিক ঢং তার মধ্যে ছিলনা। তার অনেক ছবি দেখেছি কিন্তু কেউ কি দেখেছেন তিনি দামি শাড়ি পড়েছেন। ছেলেমেয়েরাও তা-ই মায়ের মতই জীবন ধরেছেন উপভোগ করেছেন।আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখলে তারই প্রতিচ্ছবি চোখে পড়বে। আমরা শুনেছি বঙ্গবন্ধু কারাগারে। সংসারে টানাটানি, ওদিকে পার্টি চালাতেও অর্থের দরকার। কিন্তু এতোটুকু ভেঙ্গে পড়েননি। সবকিছু সাহসের সাথে মোকাবেলা করতেন।তার নিজের যেমন চাহিদা ছিলনা তেমনি সন্তানদেরও বাড়তি কোনো চাওয়া ছিলনা। কারণ তারা শিপন কালচারে অভ্যস্ত ছিলেননা। সন্তানদের তিনি বাঙালিয়ানায় অভ্যস্ত করেছেন। তাদের সন্তানরাও বিশ্ব জয় করেও বাঙালিয়ানাকে ধারণ করে চলেছেন।

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেবেন। দেশব্যাপী নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন চলছে। আন্দোলন স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে চলেছে। অলরেডি ছাত্রলীগ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কি বলবেন বঙ্গবন্ধু? বারবার দলীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করলেন। আলোচনা করলেন বুদ্ধিজীবীদের সাথেও। তবে সবাই সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন। তখন বঙ্গমাতা তাকে নিয়ে বেডরুমে শুইয়ে দেন। বলেন ১৫ মিনিট রেস্ট নাও। তখন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মাথা টিপে দিচ্ছিলেন।১৫ মিনিট পর বঙ্গবন্ধুকে জাগিয়ে বললেন কে কি বলল না বলল সে সব তোমার শোনার দরকার নেই।তুমি সারা জীবন জনগণের জন্য জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করেছো, আজও জনগণকে সামনে রেখে তোমার মনের কথাটি বলে দেবে।বঙ্গবন্ধু তা-ই করেছিলেন। ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ দিলেন সামনে ১০ থেকে ১২ লাখ লোক বেশিরভাগই বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে আসা, পুরো ভাষণটিই এক্মটেম্পোর।কোন ড্রাফট ছিলনা, নোট ছিলনা, মঞ্চে ওঠেই ভায়েরা আমার বলে ১৯ মিনিটে ১০৯৫ শব্দের যে ভাষণ দিলেন তা আজ বিগত আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত।

ঢাকা- ৫ আগস্ট ২০২০
লেখক- এমপি এবং সিনিয়র সাংবাদিক
সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব।
ই-মেইল- balisshafiq@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)