আমার শিরিন ও রুবেল এখনো উঠোনে খেলছে মনে হয়

ফয়েজ আহমেদ :
“এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন/ পাথরের টুকরোর মতন/ ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে/ বছর-তিনেক আগে কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে/ কী সহজে হয়ে গেল বলা।”

৩ বছর আগে পানিতে ডুবে ছেলের মৃত্যু নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের লেখা একটি ফটোগ্রাফ কবিতা যেন চাঁদপুরের শাহরাস্তি পৌরসভার নিজমেহার গ্রামের মৃত মোঃ আবুল বাশারের স্ত্রী শামছুন নাহারের (৫৫) জীবনের করুণ বাস্তবতা।
সময়-অসময়ে বাড়ির পূর্ব পাশের পুকুরের পাড়ে নির্বাক বসে পানির দিকে চেয়ে থাকেন।

তিনি জানান, ৩৫ বছর আগে একদিন সকালে হারিয়ে যায় তাঁর কন্যা শিরিন। পরদিন সকালে বাড়ির পশ্চিমের পুকুর থেকে তাকে মৃত উদ্ধার করা হয়। ৩০ বছর আগে তেমনি এক বিকেলে বাড়ির পূর্ব পাশের পুকুরে পড়ে যায় পুত্র রুবেল (৩)। তাৎক্ষনিক পানিতে থেকে তুলে পেট চেপে ঝাঁকানো হয়েছিলো। তারপর বাড়ির পাশে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার জানান আগেই সব শেষ।

স্মৃতি হাতড়ে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে শামছুন নাহার আরও জানান, আমার শিরিন ও রুবেল এখনো মনে হয় বাড়ির উঠোনে খেলছে। একটু পরে মায়ের আঁচল ধরে খেতে চাইবে। শিরিনের চেয়ে রুবেল অনেক ছটপটে ও ডানপিঠে ছিলো বলতেই শাড়ির আঁচলের কোনে চোখ মোছেন তিনি। পুকুর পাড়ের বাতাসের সাথে কর্পুরের মতো উবে যায় তাঁর অশ্রু। দূরে গাছের শাঁখে শঙ্খচিলের ডাকে হারিয়ে যায় অনুচ্চ ক্রন্দন ধ্বনির মর্মরিত মুর্ছনা।

‘আমার জীবনে পানি অনেক বড় বেদনার।‘ জানিয়ে উপজেলার সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়নের শোরসাক গ্রামের গণমাধ্যমকর্মী মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, ১০ বছর আগে পানিতে ডুবে মারা গেছে আমার ছোট ছেলে শিহাব। আবার বড় ছেলে রিমন ১৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর পানি থেকেই তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু একটি ট্রমা জানিয়ে উপজেলার রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নের বিজয়পুর গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক মাওঃ মোঃ মাসুম বিল্লাহ জানান, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি দুপুরে ঘরের পাশে ডোবার হাঁটুপানিতে ডুবে মারা যায় আমার ২ বছরের পুত্র মোঃ আঃ রহমান আবরার। ঘর থেকে বের হয়ে ডোবার দিকে তাকালেই স্মৃতির দগদগে ঘা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। কিছুতেই মনকে প্রবোধ দিতে পারি না।

সমাজকর্মী মোঃ মনির হোসেন জানান, পানির প্রতি সব শিশুদের আকর্ষণ থাকে। সুযোগ পেলেই তারা পানি নিয়ে খেলতে চেষ্টা করে। এজন্য ৫/৬ বছর বয়সেই তাদের সাঁতার শিখানো প্রয়োজন। এর কম বয়সীদের ব্যপারে অভিভাবকদের তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।

শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ মঈনুল ইসলাম কাজল জানান, একজন গনমাধ্যমকর্মী হিসেবে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংবাদ লিখতে গিয়ে খুবই কষ্ট পাই। মৃত শিশুর পরিবারের আহাজারি অনেকদিন চোখের সামনে ভেসে থাকে।

উপজেলার সূচীপাড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ হুমায়ূন কবির ভুঁইয়া মনে করেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটে, তার একটা বড় অংশ গ্রামাঞ্চলের। আর কর্মজীবি পরিবারের শিশুরা এর শিকার হয় বেশি। বেশির ভাগ মৃত্যুই ঘটে বাড়ির পাশের পুকুরে কিংবা ডোবায়, বাবা মায়ের হাত বাড়ানো দূরত্বে। শিশুদের জন্য অল্পস্বল্প পানি আছে এমন পুকুর ডোবাই ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। এ মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ নাসির উদ্দিন জানান, গত ১ বছরে শাহরাস্তিতে পানিতে ডুবে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের ১৬ জনের বয়স ৫ বছরের নিচে। ১ জনের বয়স ১ বছরের নিচে। এ সময়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭জন।

তিনি আরও জানান, মৃতের এ সংখ্যা উপজেলার প্রকৃত পরিসংখ্যান নয়। পানি থেকে উঠানোর পর হাসপাতালে নিলে বাঁচানো যাবে এমন ধারণা করা লোকজনই জরুরি বিভাগে আসেন। এছাড়া প্রাথমিকভাবে মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত হওয়া অনেক মৃতদেহ হাসপাতাল পর্যন্ত আনা হয় না।

গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সোসাইটি ফর মিডিয়া অ্যান্ড সুইটেবল হিউম্যান কমিউনিকেশন টেকনিকস’র (সমষ্টি) তথ্যমতে, দেশে ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এদের মধ্যে চার বছর বা কম বয়সী ৫ শ ৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩ শ ৬৩ জন, ১০-১৪ বছরের ১ শ ২ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।

আরও জানা যায়, মৃতদের মধ্যে দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৩ শ ৫৫ জন এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৬ শ ৮৬ জন মারা যায়। এছাড়া সন্ধ্যায় ৭০ জন মারা যায়। ১৯ জন রাতের বেলায় পানিতে ডুবে।
শুধুমাত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বাস্তবে পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন সমষ্টির গবেষণা পরিচালক মোঃ রেজাউল হক।

মৃত্যু জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা ও অপ্রতিরোধ্য হলেও পরিবারের সকলের চিত্তকে মাথায় তুলে রাখা ছোট্ট সদস্যটির বিয়োগব্যথা দীর্ঘস্থায়ী ভাবে শোকাতুর করে রাখে ওই পরিবারের অন্যদের। শামছুন নাহার, জসিম উদ্দিন ও মাসুম বিল্লাহ’র মতো অভিভাবকরা আদতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও ক্ষণে ক্ষণে তাদের শোকের নদীর রুক্ষ্ম চরে প্লাবন বয়। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে অভিভাবক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সাঁতারে দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন। চাঁদপুরের মতলবসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত আঁচল কেন্দ্রের (দিবা যত্ন কেন্দ্র) আদলে সারাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শিশু সুরক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করছে সচেতন মহল।

শেয়ার করুন