চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা নেই

রহিম বাদশা :
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে চাঁদপুরে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কোনা গবেষণা কার্যক্রম নেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ তথা মানুষজন আক্রান্ত হওয়ার নানামুখী উৎস ও মৃত্যুর কারণ অজানাই থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মকর্তারা মনে করেন, এ বিষয়ে গবেষণা, অনুসন্ধান কিংবা জরিপ করা হলে ভবিষ্যতে এই ভাইরাসের মোকাবেলা ও আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অনেক ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের (সিভিল সার্জন অফিস) তথ্য মতে, জেলার এখন (৩ জুন) পর্যন্ত মোট করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৩৬জন। আক্রান্তদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১৯জন, সুস্থ হয়েছেন ৪৩জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ১৭৪জন। ওই সূত্র থেকে আরো জানা যায়, জেলায় এ যাবৎ উপসর্গ নিয়ে মৃত ৪৩জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯জনের রিপোর্ট করোনা পজেটিভ, ১৯জনের রিপোর্ট নেগেটিভ। রিপোর্ট অপেক্ষমান ৫জনের।

এর বাইরে ঢাকা, নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চাঁদপুরের আরো অনেক লোক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদের অনেকে আক্রান্ত হওয়ার পর গোপনে এলাকায় চলে এসেছেন। আবার কেউ কেউ অন্যত্র মারা যাওয়ার পর গোপনে এলাকায় এনে তাদের দাফন করা হয়েছে। সেসব হিসেব সিভিল সার্জন অফিসের কাছে নেই। এছাড়া উপসর্গ নিয়ে সারা জেলায় মারা যাওয়ার সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অনেকের মৃত্যুর খবর দাফনের পর কিংবা মৃত্যুর অনেক পরে জানার কারণে স্বাস্থ্য নমুনাও সংগ্রহ করতে পারেনি।

সূত্র আরো জানায়, চাঁদপুরে জেলায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ২৩৬জনের মধ্যে চাঁদপুর সদরের ১২৪জন, ফরিদগঞ্জের ৪১জন, হাজীগঞ্জের ১৫জন, মতলব দক্ষিণের ১২জন, কচুয়ার ১৪জন, শাহরাস্তির ১৫জন, মতলব উত্তরের ১০জন ও হাইমচরের ৫জন রয়েছেন। এদের মধ্যে মারা গেছেন- চাঁদপুর সদরের ৬জন, ফরিদগঞ্জের ৪জন, কচুয়ার ৪জন, হাজীগঞ্জের ২জন, মতলব উত্তরের ২জন ও শাহরাস্তির ১জন।

জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত হিসেবে শনাক্তকৃত ১৯জনের সবার করোনা টেস্টের রিপোর্ট মৃত্যুর পর জানা গেছে। অধিকাংশের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মৃত্যুর পর। কয়েকজনের নমুনা মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পূর্বে সংগ্রহ করা হলেও তাদের রিপোর্টও মৃত্যুর পর জানা গেছে। অর্থাৎ কারো মৃত্যুর পূর্বেই জানা যায়নি তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। ফলে তারা কার্যত চিকিৎসার আওতায়ও আসেননি সেভাবে। অধিকাংশ’ই শেষ সময়ে হাসপাতালে আসার পর মারা গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত শনাক্তকৃত কোনো রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে রামপুরের কামরাঙ্গা গ্রামের এক ব্যক্তি আক্রান্ত থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর মারা গেছেন। তার মৃত্যু পূর্ববর্তী ২টি ও মৃত্যু পরবর্তী নমুনা টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।

চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসা যে ১৯জনের মৃত্যু হয়েছে এবং উপসর্গ নিয়ে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের একজনেরও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান হয়নি। পোস্টমর্টেম, সুরতহাল রিপোর্ট তো দূরের কথা চিকিৎসক দিয়ে মৃতদের বিষয়ে প্রাথমিক কোনো পর্যবেক্ষণ বা মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়নি। লিপিবদ্ধ হয়নি তাদের কেইস হিস্ট্রি। একই অবস্থা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের ক্ষেত্রেও। অবশ্য এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো নির্দেশনাও দেয়নি।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগ্রহী চিকিৎসক মৃতের কেইস হিস্ট্রি সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কিছু জানার চেষ্টা করলেও সেগুলোও প্রাতিষ্ঠানিক নথিবদ্ধ বা সংক্ষরণ করা হচ্ছে না। শুধুমাত্র নমুনা সংগ্রহের নির্ধারিত ফরমে নমুনা প্রদানকারী ব্যক্তি কি কি রোগে আক্রান্ত তার কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ থাকছে। এ ক্ষেত্রেও অনেকে তাদের উপসর্গের তথ্য গোপন করছেন।

চাঁদপুর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা যায়, একমাত্র নমুনা টেস্টের রিপোর্টের উপর চিহ্নিত করা হচ্ছে মৃত্যুর কারণ। মৃত ব্যক্তির নমুনা টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ মানেই তাকে করোনাজনিত কারণে মৃত হিসেবে ধরা হচ্ছে। আবার মৃত ব্যক্তির নমুনা টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ মানেই তিনি করোনায় মারা যাননি বলে ধরা হচ্ছে। অথচ নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক ভুল-ত্রæটির সুযোগ আছে। শতভাগ রিপোর্ট নির্ভুল হওয়ার নিশ্চয়তাও নেই।

করোনা পজেটিভ অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তি কি শুধুই করোনায় মারা যাচ্ছেন নাকি অন্য রোগের কারণে মারা যাচ্ছেন তা জানার কোনো উদ্যোগ/কার্যক্রম/কর্মসূচি নেই স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে। বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার পক্ষেও মাঠ পর্যায়ে এ বিষয়টি জানার উদ্যোগ নেই। গবেষণা তো সুদূর পরাহত বিষয়।

চাঁদপুরে এখন পর্যন্ত যতজনকে করোনায় মৃত হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগ চিহ্নিত করেছে তাদের কারোর ডেথ সার্টিফিকেট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তবে সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ জানিয়েছেন, ‘মৃতের স্বজনরা চাইলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’ একটি কোম্পানীতে চাকুরিরত এমন একজনের মৃত্যুর পর চাঁদপুর সদর হাসপাতাল থেকে প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চাঁদপুরে করোনা শনাক্তের পর প্রায় ২ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত মৃতদের এমনকি জীবিত আক্রান্তদের নিয়েও কোনো তথ্যানুসন্ধান বা গবেষণা হচ্ছে না। তৈরী হচ্ছে না তাদের কেইস হিস্ট্রি। ফলে অজানাই থেকে যাচ্ছে করোনায় মৃতদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। আক্রান্তদের নিয়েও কোনো গবেষণা নেই। স্থানীয় চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মকর্তারাও মনে করেন, এ বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা প্রয়োজন।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালের আরএমও ও করোনা বিষয়ক ফোকালপার্সন ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল মনে করেন, করোনা যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির অন্যান্য জটিল-কঠিন রোগের সহযোগী হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় তাই করোনা পজেটিভ রোগীর মৃত্যুর কমন কারণ তো করোনাভাইরাস’ই ধরে নেওয়া যায়। তাছাড়া এই ভাইরাসটি খুব শক্তিশালী। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তাও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকার চাইলে এ ব্যাপারে গবেষণা হতে পারে। এ জন্য ভিন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হবে। আমরা যারা বর্তমানে হাসপাতালে কর্মরত আছি তারা করোনা রোগী ও সাধারণ রোগী সামাল দিতেই বহু কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া গবেষণা আর চিকিৎসা ভিন্নধর্মী কাজ।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আশরাফ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা নিয়ে গবেষণা তো হচ্ছেই। আমাদের দেশে হলে আরো ভালো হতো। মাঠ পর্যায়ের গবেষণাও দরকার। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে মন্ত্রণালয়। আমি তো মনে করি সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চয়ই এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। তিনি জানান, করোনা পজেটিভ রোগীদের মৃত্যু মানেই করোনায় মৃত্যু হিসেবেই এখনো গণ্য করা হচ্ছে। তাছাড়া আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই কেইস হিস্ট্রি জানা সম্ভব হচ্ছে না। এতেই আমরা ধারণা করছি, করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপকভাবে চলছে।

চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন জানান, আনুষ্ঠানিক কোনো গবেষণা না হলেও নমুনা সংগ্রহের ফরমে সন্দেহভাজন ব্যক্তির উপসর্গ ও বিভিন্ন রোগের বর্ণনা লিপিবদ্ধ থাকছে। তাছাড়া চিকিৎসার সাথে জড়িত ডাক্তার-নার্সরাও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। ভবিষ্যতে করোনা নিয়ে গবেষণা হলে এসব তথ্য ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। তবে এখনি গবেষণা হলে তথ্য, উপাত্তসহ গবেষণার অন্যান্য নমুনা ও উপকরণ প্রাপ্তি খুব সহজ হবে।

চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা সিভিল সার্জন ডা. মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন করোনাভাইরাস নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণার এখন’ই উপযুক্ত সময়। তবে মেডিক্যাল কলেজ এবং করোনার বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে এই গবেষণা অনেক সহজতর বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গবেষণা বা জরিপ করতে হলে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ জন্য বাড়তি লোকবল নিয়োগ করতে হবে। বর্তমানে বিদ্যমান চিকিৎসক-নার্স দিয়ে করোনা ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খানও মনে করেন করোনায় আক্রান্ত ও মৃতদের নিয়ে দেশব্যাপী গবেষণা হতে পারে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা হলে ভাইরাসটি প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা সহজ হবে। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয় বলেও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

তথ্যানুসন্ধানে যতটুকু জানা গেছে, দেশে মাঠ পর্যায়ে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যু নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সারাদেশে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত মৃতদের মধ্যে একমাত্র সিলেটে একজন কয়েদীর পোস্টমর্টেম করা হয়েছে গত ১৩ মে। সেটি করা হয়েছে শুধুমাত্র আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে। তবে তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনো জানা যায়নি।

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে গণমাধ্যমে দেয়া এক বক্তব্যে করোনা বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ের পরামর্শক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (ড. আনিসুজ্জামান) অনেক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তার সর্বশেষ করোনা রিপোর্টও পজেটিভ এসেছিল। তবে তার মৃত্যুর মূল কারণ হার্ট অ্যাটাক’। তার এই বক্তব্যও গবেষণার সূত্র হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের লঞ্চডুবিতে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লঞ্চডুবির সময় সাঁতার জানা সত্তে¡ও অনেক লোক শুধুমাত্র আতঙ্কে স্ট্রোক ও হৃদরোগে মারা যান। এই তথ্যটিও করোনার গবেষণার একটি উদাহরণ হতে পারে বলে অনেক চিকিৎসক মনে করেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন