বর্ষার বিদায়ে নদী ভাঙনের আশঙ্কা পুরানবাজারবাসীর

শাওন পাটওয়ারী :
চাঁদপুর জেলার প্রাচীণ বাণিজ্যকেন্দ্র পুরানবাজার। ব্রিটিশ আমল থেকেই পুরানবাজারের ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অতীতে সওদাগররা পালতোলা বড় নৌকা নিয়ে পুরানবাজার আসতো বাণিজ্য করতে।

তবে কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরানবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় এখনও প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় এ বাণিজ্য কেন্দ্রে।

কিন্তু মেঘনার প্রবল গ্রাসে সেই প্রাচীন ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। ছোট হয়ে আসছে পুরানবাজারের মানচিত্র।

গত কয়েক দশকে পুরানবাজার বাসির শত শত ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট সব কিছু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর নদীভাঙন বন্ধ থাকলেও গত ২ বছর যাবত আবার ভাঙন দেখা দিয়েছে।

গতবছর চাঁদপুর মেঘনা নদীর শহর রক্ষা বাঁধের ২শ’ মিটার ব্লক ধ্বসে পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। এছাড়া ভাঙনে হরিসভা এলাকার ৩শ’ মিটার এলাকাজুড়ে ফাঁটল দেখা দেয়।

সেই সময় সেমিপাকা ও টিনের ৩১টি বসতঘর ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও টেক্সটাইলে বালুভর্তি বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয়ায় ভয়াবহ ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন ৮টি সনাতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ১টি মাদ্রাসা, গণকবরস্থান ও শতাধিক পরিবার।

এ বছর ৬ আগস্ট পুরানবাজার হরিসভা এলাকার মোলহেডে আবারও ভাঙন দেখা দেয়। এ সময়ের সিসি ব্লক দেবে গিয়ে হরিসভা রোডে প্রায় ২০ মিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়।

বর্তমানে প্রায় ১শ’ মিটার এলাকা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ভাদ্র মাসে সমাপ্তিতে বর্ষা শেষে পানি যখন টান দেবে তখন পুরানবাজারে প্রলয়ংকারী ভাঙনের আশঙ্কা করছেন পুরানবাজারবাসী।

১৮ আগস্ট ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লা জোনের এডিশনাল চীফ ইঞ্জিনিয়ার জহির উদ্দিন আহমেদ।

এ সময় তিনি জানান, শহর রক্ষা বাঁধের নতুনবাজার ও পুরানবাজারে সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকা স্থায়ী ও শাক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ করার জন্য ৪২১ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। যা বর্তমানে যাচাই-বাছাইয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে পুরানবাজারবাসী নদী ও পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমতে দক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে স্থায়ী বাঁধ দেখতে চায়।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি তমাল কুমার ঘোষ দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, পুরানবাজারের নদী ভাঙনের বিষয়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষামন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ ডা. দীপু মনির সাথে চেম্বার নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ রয়েছে।

পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় দুই দফা ভাঙনে ডা. দীপু মনির সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাৎক্ষণিক ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা প্রদান করেন। এ জন্য চেম্বারে পক্ষ থেকে মন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

তবে পুরানবাজারের ব্যবসায়ী মহল তথা পুরানবাজারবাসী বর্ষা শেষে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনের আশংকায় রয়েছেন। স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা না হলে একসময় হয়তো পুরানবাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

পুরানবাজারের স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণে চেম্বার অফ কমার্স এর পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আমরা চিঠি প্রদান করেছি। তারই ফলশ্রুতিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

আমরা চাই বর্ষায় নয়, শুষ্ক মৌসুমে পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমতে দক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক।

এদিকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, পানি প্রবাহের পথ সরু হয়ে আসা, নদীর নাব্যতা সংকট, নদী ড্রেজিং ব্যবস্থা চালু না থাকার কারণে বার বার চাঁদপুর নদী ভাঙনের স্বীকার হচ্ছে বলে মনে করছেন নদী ভাঙন প্রতিরোধ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ।

এ ব্যাপারে নদী ভাঙন প্রতিরোধ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির চাঁদপুর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা ব্যাংকের মুজিবুর রহমান দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন মোলহেড থেকে শুরু করে পুরানবাজারের রনাগোয়াল এলাকা পর্যন্ত চরম ভাঙনের ঝুঁকি রয়েছে। ভাদ্র মাসের শেষে পানির স্তর নিচে নেমে আসলে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিতে পারে।

চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষার্থে আমাদের কমিটি এ পর্যন্ত একাধিকবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেছেন। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, মেঘনা দিয়ে পানি প্রবাহের পথ সরু হয়ে আসা, নদীর নাব্যতা সংকট, নদী ড্রেজিং ব্যবস্থা চালু না থাকার কারণে বার বার চাঁদপুর নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই চাঁদপুরের মত একটি জেলাকে নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি ইতিমধ্যেই সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার কাজ করিয়েছেন। তবে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে নদীর তীর বেঁধে পুরোপুরি ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রতিবছর দফায় দফায় ভাঙনের কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

নদীর পানি সঠিকভাবে প্রবাহ হতে পারছে না। পানি প্রবাহকে বাধা প্রদান করছেন অসংখ্য জেগে ওঠা ডুবোচরগুলো। পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলে নদীর ব্যাসার্ধ রয়েছে ৯ কিলোমিটার। আর মেঘনা দিযয়ে যে পানি প্রবাহ হচ্ছে তার ব্যাসার্ধ ১ কিলোমিটার।

ফলে ৯ কিলোমিটার এলাকার পানি ১ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে প্রবাহের কারণে নদীতে প্রবল ঘূর্ণিস্রোতের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে নদীর তীরে এসে। শহর রক্ষা বাঁধকে সবচেয়ে হুমকিতে ফেলেছে বাঁশগাড়ি ও মিনি কক্সবাজারের দু’টি চর।

এই দুটি চর মেঘনা পদ্মার পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। এছাড়া আরো অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। এই চরগুলোকে ড্রেজিং করতে হবে, নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হবে। ১৯৭৩ সালে কমরেড আবদুল্লাহ সরকার বঙ্গবন্ধুর সামনে সংসদে চাঁদপুরকে রক্ষার্থে নদীর ড্রেজিংয়ের কথা উত্থাপন করেছিলেন।

তিনি আরো বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মেঘনায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। খুব সহসাই চাঁদপুরকে নদীর ভাঙনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষার্থে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।

এদিকে পুরানবাজারের ভাঙন নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যবসায়ী। তারা জানান, পুরানবাজারে ভাঙন শুরু হয়েছে এ খবর শোনা মাত্রই চাঁদপুরের বাইরের অনেক ব্যবসায়ী বাকিতে মাল বিক্রি ও বড় লেনদেন করা থেকে বিরত থাকেন। আর ব্যাংকঋণ বন্ধ রয়েছে তো সেই বহু বছর আগে থেকেই।

পুরানবাজার বাসীর দাবি, চাঁদপুরকে রক্ষা করতে হলে পুরানবাজারকে বাঁচাতে হবে। চাঁদপুরকে নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতিবছর সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। অপরিকল্পনা, অদক্ষ মুনাফালোভী ঠিকাদার ও সুনির্দিষ্ট নদীশাসনের অভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ মেঘনার পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এতে ক্ষতি গুণছে সরকার ও চাঁদপুরবাসী।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)