স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলেই কলিজা ফেটে যায় শাহিদা বেগমের

ফয়েজ আহমেদ :
পাঁচ বছর ধরে পথ চেয়ে আছেন বিদ্যালয়ে ও শ্রেণীকক্ষে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননকারী শাহরাস্তি উপজেলার ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনুর মা শাহিদা বেগম।

ঘটনার ৫ বছর অতিবাহিত হলেও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আইনি চোখ ফাঁকি দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে মামলার মূল আসামী মমিন হোসেন তারেকসহ অন্যরা।

তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষপাতদুষ্ট অভিযোগ গঠনের কারণে দফায় দফায় তদন্ত কার্যক্রম পরিবর্তন ও আসামী পক্ষের হুমকি ধমকির ফলে বোন হারানোর বিচার চেয়ে ভীতির মধ্যে জীবন কাটাতে হচ্ছে- এমন অভিযোগ বাদী পরিবারের।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনু শ্রেণিকক্ষে ও বিরতির সময় ক্যাম্পাসে সহপাঠীর দ্বারা উত্যক্তের শিকার এবং উত্যক্তকারীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নাজেহাল হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

ওই ঘটনার ৫ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশ মিনুর মা শাহিদা বেগম। তবে তিনি বিচার পাওয়ার আশায় রয়েছেন।

সরেজমিনে হাঁড়িয়া গ্রামে মিনুর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মিনুর মায়ের সাথে। সংবাদকর্মীদের দেখেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি রাস্তায় বের হই না, স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলে আমার কলিজা ফেটে যায়।

বিকেল হলেই মনে হয় দলবাঁধা মেয়েদের সারি হতে ছুটে এসে স্কুল ব্যাগ খাটে ছুঁড়ে মিনু আমায় ডাকছে- “মা, খেতে দাও” সে আশায় আজো তার পথ চেয়ে আছি। আমি একটু বিচার চেয়েছি, তাও আজ এটা, কাল ওটা।

দোষীদের শাস্তি দেখলে আমার মিনুর আত্মা শান্তি পাবে। যাদের কারণে আমার মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো আমি তাদের বিচারের আশায় রয়েছি।

উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের পন্ডিত বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার মিনু। তাকে প্রায়ই প্রেম নিবেদন ও উত্যক্ত করতো সহপাঠী একই ইউপির সংহাই গ্রামের প্রবাসী আবু তাহেরের ছেলে তারেক। তারেক কোনোভাবে মিনুকে পটাতে না পেরে মা রূপবান বেগম ও বোন কনিকাকে সহযোগিতা করতে বলে।

এ ব্যাপারে ঘটনার ৩ দিন আগে ১৭ আগস্ট ২০১৫ইং সোমবার বিকেলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেনের নিকট শারমিনের ছোট ভাই নয়ন মৌখিক ভাবে একটি অভিযোগ দেয়।

২০ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে ইংরেজি ক্লাস চলাকালে রূপবান বেগম ক্লাসের ভেতর ঢুকে মিনুকে দাঁড় করায়। পরে তার ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়।

এ প্রস্তাব মিনু প্রত্যাখ্যান করলে তারা মিনুকে অকথ্য ভাষায় বিভিন্ন প্রকার গালিগালাজ করে। পরে বিরতির সময় রুপবান বেগমের সাথে তার মেয়ে কনিকা এসে আরো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। ওই সময় তারেক মিনুকে চড় মারে ও মুখে থুতু দেয়।

উপস্থিত অন্যান্য সহপাঠীদের সামনে অপমানিত হয়ে রাগে ক্ষোভে চতুর্থ ঘন্টার পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় মিনু। এরপর তাদের বসতঘরের নিচতলায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। পরিবারের সদস্যরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মিনুর আত্মহননের পর তার ঘর হতে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ। যাতে লিখা ছিলোঃ ‘মা, ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কণিকা। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ তোমরা নিও।’

ঘটনার পর মিনুর ভাই শাহাবুদ্দিন নয়ন ৫জনের নাম উল্লেখ করে শাহরাস্তি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শুধুমাত্র তারেককে গ্রেফতার করা হয়।

মামলার বাদি শাহাবুদ্দিন নয়ন জানান, ধূর্ত তারেকের পরিবার অর্থের বিনিময়ে বয়স কমিয়ে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে। তাতে তারেকের বয়স দেখানো হয় ১৭ বছর ৫ মাস ১২ দিন। অথচ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসাপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি) ডা. এম মাঈন উদ্দিনের মেডিকেল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তারেকের বয়স ২০ বছর।

এই ভুয়া জন্মসনদ দ্বারা তারেককে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে ৩২ দিন কারাবাস শেষে প্রতারণামূলক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার জামিন নেয়া হয়। কিন্তু মিনুর আত্মহত্যায় প্রধান প্ররোচনাকারী বখাটে তারেকের মা রূপবান বেগম ও তার বোন কনিকা আজো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

মিনুর আত্মহননের ৩ দিন পর লিখিতভাবে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান পাটওয়ারী। তার প্রতিবেদনে ইভটিজিংয়ের কোন ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি। ২৩ আগস্ট ২০১৫ তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আলী আশ্রাফ খান এর নিকট ওই প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে তারেক, তার মা রুপবান বেগম ও বোন কনিকার অপরাধ আড়াল করে বিদ্যালয়ে ইভটিজিংয়ের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং শারমিন ও তার অভিভাবক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট ইভটিজিং অথবা কোন উশৃঙ্খল আচরণের জন্য তারেকের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে কোন লিখিত অভিযোগ দেয়নি মর্মে উল্লেখ করা হয়।

ভিকটিমের পরিবার আরো জানায়, দক্ষিণ সূচীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বখাটে আচরণের দায়ে বহিষ্কার হওয়া তারেককে কোন প্রকার ছাড়পত্র (টিসি) ছাড়াই এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে প্রধান শিক্ষক।

ওই ঘটনায় অপরাধীকে বিদ্যালয় হতে বহিষ্কার না করে তার শিক্ষাজীবন অক্ষুন্ন রাখতে প্রধান শিক্ষকের প্রচেষ্টায় লাকসামের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।

জাতির বিবেক খ্যাত শিক্ষকের অপরাধিদের সাথে এমন সখ্যতা ও অপরাধি পরিবারকে বাঁচাতে তার এহেন কর্মকান্ডে একজন শিক্ষকের পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম নিয়েছে।

ওই মামলায় শাহরাস্তি থানার তৎকালিন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ নিজাম উদ্দিন গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারেক ও তার মা রুপবান বেগমকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে। এতে মামলা থেকে ৩জন আসামীর নাম বাদ দেয়া হয়।

তারা হলো- মৃত আব্দুল জলিলের পুত্র তারেকের বন্ধু আবু রায়হান, ছালেহ আহমেদের পুত্র মোঃ শামীম হোসেন ও তারেকের বোন নুরুন্নাহার আক্তার কনিকা।

এরপর গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে অভিযোগ পত্রে তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত করেছেন মর্মে তার দাখিলকৃত চার্জশীটের উপর নারাজি আবেদন করেন বাদিপক্ষ।

গত ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখ নারাজি আবেদন মঞ্জুর হয়ে মামলাটি বিজ্ঞ আদালত সিআইডিতে প্রেরণ করে। সিআইডি পুনঃতদন্ত শেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আবারো তদন্তের নির্দেশ দেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২০১৭ সালে তারেক, তার মা রূপবান বেগম ও বোন কণিকাকে আসামী করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। যা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।

মিনুর ভাই মামলার বাদি শাহাবুদ্দিন জানান, জামিনে এসে তারেক ও তার মা তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারেক জামিন নিয়েছে, তার মা ও বোন প্রকাশ্যে ঘুরছে।

তারা জনসম্মুখে বলে বেড়াচ্ছে, মামলা শেষ হয়ে গেছে, কোনো কিছুই হবে না। শাহাবুদ্দিন আরো জানান, নিজের বোন হারানোর ঘটনার বিচার চেয়ে নিজেই প্রাণ শংকায় রয়েছি।

ইভটিজিং ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও জামিনে এসে বখাটে তারেক ও অন্য আসামীরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা ও বাদি পরিবারের সদস্যদের মামলা তুলে নেয়ার হুমকি ক্ষীন করে তুলছে মিনুর মায়ের বিচার পাওয়ার আশা। ওই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে স্থানীয়রা।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)