হাজীগঞ্জ মৎস্য অফিসে মনতাজ মিয়ার প্রতারণায় দিশেহারা জেলেরা

শরীফুল ইসলাম, হাজীগঞ্জ থেকে ফিরে :
হাজীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য অফিস কার্যালয়টি কোন উপায়ে দালাল মুক্ত হচ্ছে না। এই কার্যালয়ের অফিস সহকারি আব্দুর রবের সহযোগি দালাল মনতাজ মেম্বারের কাছে পরাস্ত হতে হচ্ছে অসহায় জেলে এবং চাষীরা। একের পর এক চাষী এবং জেলেদের সাথে প্রতারণা করে আসলেও অজানায় থেকে যায় এ চতুর মনতাজের হীন কর্মকান্ড।

স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারলেও অনিয়মের দায়ে বদলী হওয়া সাবেক ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদ মোস্তফার বদৌলতে লিফ হিসেবে নিয়োগ পেয়ে চাষী এবং জেলেদের বিভিন্ন উপকরণ ও সুবিধা দেওয়ার কথা বলে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য করে আসছেন মনতাজ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার ৬নং বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড (এন্নাতলী-বড়কুল) ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মনতাজ। মাছের পোণা উৎপাদনের কারণে সখ্যতা তৈরী হয় উপজেলা মৎস্য অফিসের অফিস সহকারী মোঃ আব্দুর রবের সাথে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত কাজে-বিনা কাজে মৎস্য অফিসে ঘুরাফেরা শুরু করে মনতাজ। এরপরই জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে।

গত ৩ বছর আগে এ উপজেলার অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে রামগঞ্জ উপজেলায় বদলী হওয়া ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদ মোস্তফাকে অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমে বড়কুল রামকানাই উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ভূয়া সনদ দিয়ে লিফ হিসেবে নিয়োগ পায় মনতাজ মেম্বার।

যদিও ইউনিয়ন ভিত্তিক লিফ নিয়োগ পেতে সর্বনিন্ম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাশ হতে হয়। এসব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কখনো উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছের লোক, কখনো ইউনিয়ন মৎস কর্মকর্তা, আবার কখনো সফল চাষী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে প্রতারণার ফাঁদ বসায় মনতাজ। পূর্বেও অনেক চাষী ও জেলে মনতাজের প্রতারণায় সর্বশান্ত হয়েছেন।

প্রতিটি ইউনিয়নের চাষী এবং জেলেদের সাথে যোগাযোগ রাখতে গড়ে তুলেন দালাল চক্র। যার নিয়ন্ত্রণের মহানায়ক মনতাজ। এমন কি অফিসে বসেই রব এবং মনতাজ চক্রের ঘুষ লেনদেনের একটি ভিডিও ফুটেজও প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

গত সেপ্টেম্বর ২১ সেপ্টেম্বর হাজীগঞ্জ উপজেলা মৎস কর্মকর্তার বরাবর অফিস সহকারি আব্দুর রব ও বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের লিফ মনতাজের বিরুদ্ধে ঘুষের টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে অভিযোগ দায়ের করে উপজেলার দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নের চারিয়ানী গ্রামের নিবন্ধিত জেলে বিপ্লব চন্দ্র সরকার।

বিপ্লবের দায়েরকৃত অভিযোগে উঠে আসে অফিস সহকারী আব্দুর রব ও মনতাজের দুর্নীতির ভয়াল চিত্র। কিছুদিন আগে বিপ্লব হাজীগঞ্জ মৎস্য অফিসে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণে নাম দিতে মৎস্য অফিসে আসলে তাকে অফিস সহকারী আবদুর রব সাহেব বলে আমাকে প্রশিক্ষণে ঢুকানো যাবে না।

প্রশিক্ষণে ব্যাচ পূরণ হয়ে গেছে। পরে কিছুক্ষণ অফিসে ঘুরার পরে দালাল মনতাজ মিয়া তাকে প্রস্তাব করে খরচ দিলে টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিবে। মনতাজ মিয়া অফিস সহকারী রবের সাথে কথা বলে বিপ্লবকে ৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করে। তখন বিপ্লব বলে, খুবই গরীব মানুষ। আমার পক্ষে এত টাকা দেয়া সম্ভব না। রব সাহেব এর সাথে কথা বলতে গেলে মনতাজ মিয়ার সাথে কথা বলতে বলে এ অফিস সহকারী।

বিপ্লব বলেন, মনতাজ মিয়া আমাকে বলে টাকা না দিলে প্রশিক্ষণে ঢুকা যাবে না। পরে আমি রব সাহেবকে ১ হাজার টাকা দিলে উনি আমার টাকা ছুড়ে ফেলে দেয় এবং আমাকে ২ দিনের মধ্যে ৪ হাজার টাকা না দিলে আমার জেলে কার্ড বাতিল করার হুমকি দেন। অতএব মহোদয়ের নিকট আকুল আবেদন এই যে, অফিস সহকারী আবদুর রব এবং লিফ মনতাজ মিয়া এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে এবং এ অন্যায়ের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করতে আপনার মর্জি হয়। জেলে বিপ্লবের দায়ের করা অভিযোগে উঠে আসে রব-মনতাজের নানান কু-কর্ম।

মনতাজের লিফ বাতিলের জন্য দুজন ভুক্তভোগী বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের উত্তর বড়কুল সিআইজি সমিতির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তবদীল হোসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈশাখী বড়ুয়ার বরাবর গত ২৮ সেপ্টেম্বর এবং ২৯ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড কোন্দ্রা গ্রামের মাছ চাষী মো. আব্দুল গফুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

শুধুই জেলেদের প্রশিক্ষণ উপকরণ বিতরণ নয়, চাষীদের প্রদর্শনী পাইয়ে দেওয়ার নামে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সে লিফ হয়ে এন্নাতলী সিআইজি সমিতির পুরো নিয়ন্ত্রণ রেখেছে তার কাছে। এ সমিতির ২০জন সদস্যের মধ্যে নামসর্বস্ব কয়েকজন সদস্য রেখে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং আত্মীয় স্বজন নিয়ে কমিটি গঠন করে নিজের স্ত্রী ছালেহা বেগম কে সভাপতি পদ দিয়ে নিজেই সভাপতির দায়িত্ব পালন করে।

দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক ভারপ্রাপ্ত মৎস কর্মকর্তা মাহমুদ মোস্তফার সময়ে প্রভাব খাটিয়ে মনতাজ মেম্বার তার প্রবাসে থাকা ছেলে জহিরের নামে পঞ্চাশ হাজার টাকার প্রর্দশণী নেয়। তদন্তের সময়ে সে তার প্রতিবন্ধী ছোট ছেলেকে দেখায়।

কখনো নিজের নামে, স্ত্রী নামে এবং ছেলের নামে বিভিন্ন প্রদর্শণী নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কোনো চাষী তার কাছে পরামর্শের জন্য গেলেই সর্বনাশ ডেকে আসে তাদের। ভুল পরামর্শ দিয়ে চাষীদের মাছ মরার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাষীদের পরামর্শ দেওয়ার নাম করে আর্থিক লেনদেন এবং প্রদর্শণী দেওয়ার নামে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ এর পূর্বে একাধিক চাষী দিলেও বহাল তবিয়ে চলছে রব-মনতাজ সিন্ডিকেট। মনতাজ অফিসের কর্মকর্তার নামে ঘুষ নিলেও তা জানে না সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা।

এ রকম বহু ঘটনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, মাহমুদ মোস্তফা স্যারের সময়ে মনতাজ মেম্বার ছাগল দেওয়ার নাম করে প্রত্যেক জেলের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেয়। দুটি ছাগলের মধ্যে যে জেলে তাকে একটি করে ছাগল দিয়েছে তারাই ছাগল পেয়েছে। সে কত বড় বাটপার সারাদিন বলেও শেষ করা যাবে না। সরাসরি তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। যদি কেউ প্রতিবাদ করে রব এবং মনতাজ তাকেই জেলে নিবন্ধন কার্ড বাতিলের ভয় দেখায়।

বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের চাষী মুক্তিযোদ্ধা তবদীল হোসেন বলেন, মনতাজ এর আগেও বহু অপকর্ম করেছে। আমি উত্তর বড়কুল সিআইজি সমিতির সদস্য সে আমার নামের প্রর্দশনী সাবেক মৎস কর্মকর্তা মাহমুদ মোস্তফাকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে নিজের নামে নিয়ে যায়। তাকে লিফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও সে কোন কাজই করে না। সে একটা ধান্দাবাজ, এটা-সেটা দেওয়ার নামে বাটপারি করে বেড়ায়। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত মনতাজ মেম্বার বলেন, জেলে বিল্পব চন্দ্র সরকার নামে কাউকে চিনি না। আর তার অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি কোন জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেই নি। আমি হাজী মানুষ, মিথ্যা কথা বলি না। কেউ যদি অভিযোগ করে, কোন প্রমান করতে পারে করুক।
উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মো. শামছুল আলম পাটওয়ারী বলেন, আমি মনতাজ মেম্বারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি করা একটি অভিযোগ পত্র হাতে পেয়েছে। আমরা তদন্তের বাইরে কিছু করতে পারবো। আমাদের বিভাগ থেকে সঠিক তথ্য ও প্রমাণ পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)