রহিম বাদশা :
হাজার বছরের প্রাচীণ জনপদ চাঁদপুর। নদী আর চাঁদপুর একে অপরের পরিপূরক। নদীকে কেন্দ্র করে এই শহরের উৎপত্তি, প্রসিদ্ধি, বিবর্তন, বিকাশ। পদ্মার ভূবণখ্যাত ইলিশ, সুবিশাল মিঠাপানির জলরাশি, সহজলভ্য নৌপথ এই জনপদকে যেমন জগৎজুড়ে খ্যাতি দিয়েছে আবার সেই নদীর হিংস্র থাবা চাঁদপুরের শত বছরের প্রধান প্রতিবন্ধতা হয়ে আঘাত করেছে বেশুমার।
নদী যেমন চাঁদপুরকে দিয়েছে অকৃপণভাবে। নিয়েছেও অনেক। নদী আর চাঁদপুরের এই আদান-প্রদানের সম্পর্ক তবুও একসঙ্গে মিতালী করে সতত ধারায় প্রবাহমান। নদীকেন্দ্রিক এই জেলার সকল উন্নয়ন-সম্ভাবনা নদীতে ঘিরেই আবর্তিত।
ভৌগলিক কারণে চাঁদপুর শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অজুত গুরুত্ব বহন করে চলেছে। প্রকৃতি আর মানচিত্র দু’য়ে মিলে অমিত সম্ভাবনাময় এই জনপদ।
পদ্মা-মেঘনার কোলে ঠাঁই পাওয়া চাঁদপুর নামক জনপদের প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি ব্রিটিশ শাসনামলে। চাঁদপুরে অবিভক্ত বাংলার মহকুমা শহর ও পৌরসভার পত্তন ঘটেছিল ব্রিটিশদের হাতেই।
দূরদর্শী ব্রিটিশ শাসকেরা চাঁদপুরের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করেই এখানে গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ নৌবন্দর, পাট ব্যবসার কেন্দ্র ও বাণিজ্য কেন্দ্র। তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুরের রেল যোগাযোগ। শত শত বছর পর এসে এসব খাতের আবেদন তো কমেইনি বরং এসবকে ভিত্তি ধরে নতুন নতুন উন্নয়ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে।
নদী ও চাঁদপুর : দেশের প্রধান দুই নদী পদ্মা-মেঘনা আর স্থানীয় ডাকাতিয়া-ধনাগোদা নদীকে ঘিরে চাঁদপুরে প্রায় ১১৮ কিলোমিটার নৌপথ বিদ্যমান। এর বাইরে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল। নৌপথের সহজলভ্য নৌপরিবহনের ফলে চাঁদপুরের সাথে একসময় বহু দেশের সমৃদ্ধ নৌযোগাযোগ ছিল। দেশভাগের কারণে বহির্দেশীয় নৌরুটে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলেও আভ্যন্তরীন নৌবন্দর হিসেবে চাঁদপুরের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।
রাজধানী ঢাকা, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে আজো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে চাঁদপুরের নৌপথ ও রেলপথ। দ্রুতগামী আধুনিক নৌযান ও রেল সার্ভিস চালু করা গেলে চাঁদপুর হতে পারে দেশের শীর্ষ রেল জংশন ও নৌবন্দর।
বিশেষ করে চাঁদপুর-সিলেট রেলরুট পুনরায় ট্রেন চালু হলে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকার মানুষ চাঁদপুরের রেলপথের সুবিধা ভোগ করতে পারবে। অন্যদিকে ঢাকা-চাঁদপুর সরাসরি রেললাইন চালু হলে ঢাকার সাথে চাঁদপুরের যোগাযোগে নতুন বিপ্লব সাধিত হবে। নতুন এই রেলপথ নির্মাণ ব্যয়বহুল হলেও এর সাথে সড়কপথ যুক্ত করলে দীর্ঘমেয়াদে তা সরকারি অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
সড়ক কাম রেলপথটি পর্যটকবান্ধক করলে এর বহুমুখী ব্যবহারে ব্যয়বহুলের বিষয়টি আরো গৌণ হবে। এটি করা গেলে ঢাকার সাথে চাঁদপুরের রেলপথের দূরত্ব এক ঘন্টারও কম সময়ে নেমে আসবে। সড়কপথের দূরত্ব প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। তখন চাঁদপুর অথবা ঢাকার এক স্থানে বসবাস করে অন্যত্র অফিস/ব্যবসা/কাজ-কর্ম করা যাবে।
উন্নতবিশ্বের বহু দেশে রাজধানীর সাথে অদূরবর্তী শহরের এমন সহজ যোগাযোগ রয়েছে। যা রাজধানী শহরের উপর জনবসতির চাপ অনেক কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশে-দেশেও এমন নজির আছে। যেমন সিঙ্গাপুরের জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল বলে অনেকেই সিঙ্গাপুরের সীমান্তবর্তী মালয়েশিয়ায় জীবনযাপন করেন।
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তারা প্রতিদিন সিঙ্গাপুর আসা-যাওয়া করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরে জীবিকা নির্বাহ করেও হাজার হাজার মানুষ শহর থেকে দূরে বসবাস করেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। তা সম্ভব হচ্ছে উন্নত ও দ্রুতযোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে।
ঢাকা-চাঁদপুরের প্রস্তাবিত এই রেলপথ ও সড়কটি হতে পারে নদীর অদূরে বর্তমানে বিদ্যমান সড়কগুলোর প্রশস্ততা ও উন্নয়ন সাধন করেই। যা মেরিন ড্রাইভের আদলে গড়ে তুললে একই সাথে এটি দেশের বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্রেও রুপ নেবে। তখন ঢাকা থেকে কয়েক ঘন্টা সময় নিয়েই এখানে এসে বেড়ানো যাবে। একদিনের ভ্রমণে জেলার প্রধান প্রধান পর্যটন কেন্দ্র দেখার সুযোগ মিলবে।
ভ্রমণপিপাসুদের দীর্ঘমেয়াদী ভ্রমণে উৎসাহিত করবে। পর্যটনের ব্যাপক প্রসারে হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, গাইড, ট্যুর অপারেটর সব মিলিয়ে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। অর্থাৎ চাঁদপুরের বিদ্যমান নৌ, রেল ও সড়ক যোগাযোগ যুগোপযোগী করে তার সাথে আকাশপথের ব্যবহার চালু করা গেলে চাঁদপুর হবে রাজধানী ঢাকার উপশহর।
চাঁদপুরে এক সময় যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে হেলিকপ্টার চলাচল করতো। এখানে স্থায়ী হেলিপ্যাডও ছিল। যুগের দাবিতে আজ চাঁদপুরে বিমানবন্দর স্থাপনের যৌক্তিকতা দেখা দিয়েছে। একে তো চাঁদপুরের মানুষ বেশ সৌখিন তারওপর প্রতিদিন প্রচুর প্রবাসী চাঁদপুর থেকে ঢাকা হয়ে প্রবাসে যাতায়াত করতে হয়। এখানে বিমানবন্দর চালু হলে এটি যেমন লাভজনক বিমানবন্দর হবে তেমনি জেলাবাসীর পরিবহন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নতি ঘটবে।
তাছাড়া চাঁদপুরের বিস্তীর্ণ নদীতে নৌ-বিমানবন্দর চালুর যৌক্তিকতাও দিনে দিনে দৃঢ় হচ্ছে। এটি হলে চাঁদপুরে হবে দেশের প্রথম নৌ-বিমানবন্দর। নৌ কিংবা স্থল যে কোনো ধরনের বিমানবন্দর স্থাপনের পর্যাপ্ত জমি ও পরিবেশ রয়েছে শহরের কোড়ালিয়া চর থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত এলাকায়।
চাঁদপুরকে জগতজুড়ে প্রসিদ্ধ করতে নদীর আরেক অনুসঙ্গ ইলিশ। বিশ্বের বহু দেশে নানা প্রজাতির ইলিশ মিললেও স্বাদে-গুণে পৃথিবীতে অনন্য চাঁদপুরের পদ্মার রূপালী ইলিশ। কেবল ভারতীয় উপমহাদেশ’ই নয়, সভ্যতার শিখরে অবস্থানকারী ইউরোপ-আমেরিকায়ও চাঁদপুরের ইলিশের চাহিদা সর্বশীর্ষে। এই ইলিশকে লালন-পালন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে ইলিশকেন্দ্রিক বিপুল অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি হতে পারে।
চাঁদপুরে পর্যটনের প্রধান অনুসঙ্গ হতে পারে এই ইলিশ। আশার কথা হচ্ছে, সুদূরপ্রসারী সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলার স্বীকৃতি পেয়েছে চাঁদপুর। ইলিশ রক্ষা এবং ইলিশকেন্দ্রিক পর্যটনের প্রচার-প্রসারে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এই উদ্যোগ সফল হলে ইলিশ হতে পারে চাঁদপুরকে পাল্টে দেওয়ার প্রধান উপকরণ। নিশ্চিত হবে নদীর বহুমুখী ব্যবহার।
একমাত্র ও শুধুমাত্র সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব চাঁদপুরকে রাজধানী ঢাকার সাথে যোজন যোজন দূরত্ব করে রেখেছে। সরাসরি সহজ স্থলপথ নেই বলেই ঢাকার খুব কাছে থেকেও চাঁদপুর বহুদূরে অবস্থান করছে। অথচ চাঁদপুরের সর্বউত্তর প্রান্ত (ষাটনল) থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার। নৌপথে এই দূরত্ব ষাটনল থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
দ্রুতগামী নৌযান খুব সহজেই ঢাকার সাথে চাঁদপুরের নৌযোগাযোগে দূরত্ব কমাতে সক্ষম হবে। আধুনিক দ্রুতগামী নৌযানে মাত্র ১ ঘন্টায় ঢাকা-চাঁদপুরের যাতায়াত সম্ভব। অন্যসব পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার চেয়ে এটি অনেক সহজসাধ্য, দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য ও কম ব্যয়ের ক্ষেত্র।
বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা কিংবা সরকারের বিআইডবিøউটিসি এমন দ্রুতগামী নৌযান খুব কম সময়ের প্রচেষ্টায় চালু করতে পারে। ব্রিটিশ আমলের বিকলপ্রায় রকেট-স্টিমারগুলোর স্থলে এসব আধুনিক যান যুক্ত করা যেতে পারে।
চাঁদপুর-শরীয়তপুর ফেরিরুটও দেশের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই ফেরিরুটের স্থলে চাঁদপুর-শরীয়তপুরের মধ্যে একটি দীর্ঘতম সেতু নির্মাণও এখন সময়ের দাবি। প্রস্তাবিত এই সেতু চালু হলে চাঁদপুরের যোগাযোগ ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন ঘটবে।
অন্যদিকে ঢাকা-চাঁদপুর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে ভবিষ্যতে তা চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এই সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিকল্প সড়কে রূপ নিয়ে দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। অন্যদিকে ঢাকা-চাঁদপুর রেলপথ হলে সেটিও বর্তমান বিদ্যমান রেলপথে লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম যাতায়াতের সংক্ষিপ্ত পথে রূপ নেবে।
আবার চাঁদপুর থেকে লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী-ফেনী হয়ে লাকসাম-চট্টগ্রামের বিকল্প রেলপথ চালুর সুযোগ রয়েছে। সম্ভাব্য ঢাকা-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম সড়ক, চাঁদপুর-শরীয়তপুর সেতু এবং ঢাকা-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রেলপথ চালু হলে ভৌগলিক সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে চাঁদপুর।
আশার খবর হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট কমাতে সরকার যেসব বৃহৎ পরিকল্পনা করছে তার মধ্যে একটি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে দাউদকান্দি থেকে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে স্থাপন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর পর্যন্তও এমন এলিভেটড এক্সপ্রেসওয়ে করা যেতে পারে। এর সাথেই যুক্ত থাকতে পারে প্রস্তাবিত রেলপথ, সড়কপথ ও রিভারড্রাইভ।
তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনামল ও অবিভক্ত ভারতের শাসনামলের আদলে ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত অনুন্নত রাজ্যগুলোর সাথে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের যাতায়াতেও ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে চাঁদপুরের সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথ।
এতসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে ব্রিটিশ-ভারতের সিংহদ্বারখ্যাত চাঁদপুর আবারো ভারতীয় উপমহাদেশের অতিগুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টে রূপ নিতে পারে। যা এখানকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবিস্মরণীয় উন্নতি সাধন করতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে, বিগত কয়েক শতাব্দীব্যাপী চাঁদপুরের প্রধান সমস্যা নদী ভাঙন এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নদী ভাঙনের লাগাম টেনে ধরায় একটা স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। যা এই জনপদের মানুষ ও সরকারকে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে।
তবে নদী ভাঙনের বিষয়টি অনিশ্চিত ও প্রকৃতিনির্ভর হওয়ায় বর্তমান স্থিতিশীল অবস্থায় বসে থাকলে চলবে না। বরং এই স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতবিশ্বের নদীশাসনের মডেল অনুসরণ করে আরো টেকসই ও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে এখন’ই। নইলে ফের নদী ভাঙনের ভয়াবহতা দেখা দিলে উন্নয়ন আর সম্ভাবনার অনেক কিছুই ভেস্তে যাবে। যতটুকু এগিয়েছি আমরা তার চেয়ে অনেক দূরে পেছনে চলে যাওয়ার শঙ্কাও থেকে যাবে।
এসব বহুমুখী প্রস্তাবনার এক বা একাধিক প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকার সাথে চাঁদপুরের সহজ ও দ্রুত যাতায়াত নিশ্চিত করা গেলে অচিরেই ঢাকার উপশহরের পর্যাদা যাবে চাঁদপুর। সেটি হলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চাঁদপুরের ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পায়ন, পর্যটন, কর্মসংস্থান, অর্থনেতিক উন্নয়ন তথা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আকাশচুম্বী উন্নতি ঘটবে। তার প্রভাব পড়বে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে।
সম্ভাব্য কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব তুলে ধরছি :
১. চাঁদপুর জেলা বিশেষ করে মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ ও চাঁদপুর উপজেলায় দেশী-বিদেশী ব্যাপক শিল্প ও কলকারখানা স্থাপিত হবে। ইতিমধ্যে সরকারিভাবে মতলব উত্তর ও হাইমচরে একাধিক অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যা আরো অনেক বিনিয়োগকারীকে উৎসাহিত করবে।
২. উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা এখানকার পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক উন্নতি ঘটাবে। দেশ-বিদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসবে। এতে পর্যটনভিত্তিক ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হবে। প্রাণ পাবে এখানকার দর্শনীয় পর্যটন স্পটগুলো। চরাঞ্চলে পর্যটনের নতুন নতুন স্থাপনা ও সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হবে।
৩. উন্নত যোগাযোগ স্থানীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক আয়োজন বিনিময় বৃদ্ধি পাবে।
৪. উন্নত পিকনিক স্পট তৈরীর পাশাপাশি নাটক-সিনেমার স্যুটিং স্পট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে চাঁদপুর। বিশেষ করে নদী, গ্রামীণ পরিবেশ পর্যটনের জন্য বেশ উপযোগী। নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম চাঁদপুরে স্বপ্নজাল সিনেমা নির্মাণ করে এখানকার স্যুটিং অনুক‚ল পরিবেশের প্রশংসা করেছেন।
৫. উন্নত দ্রুত যাতায়াত নিশ্চিত হলে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে ফুটবল, ক্রিকেটসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে চাঁদপুর স্টেডিয়াম। যা এখানকার ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবে।
৬. নদী ও উপকূলের জেলা চাঁদপুর ভৌগলিক কারণে এমন এক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত সেখানে নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সদর দপ্তর হলে এসব বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হবে এবং রাজধানীর উপর সরকারি দপ্তরের চাপ কমবে। পাশাপাশি এখানে ভবিষ্যতে সেনানিবাস স্থাপনের যৌক্তিকতা দৃঢ় হবে। এই সবই সহজ হবে উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে।
৭. ভারি ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। যা জেলাবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
৮. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে এখানকার হারিয়ে যাওয়া পাট ও বস্ত্র শিল্প, লবণ শিল্পের পনরুত্থান হবে।
৯. কৃষিনির্ভর চাঁদপুরে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। যা কৃষকদের আরো বেশি ফসল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য চাঁদপুরে একাধিক সবজির কোল্ড স্টোর চালুর চাহিদা রয়েছে। এতে কৃষিপণ্যের চাহিদা, যোগান ও দামে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে।
১০. ইলিশ সংরক্ষণ, প্রসেসিং ও বৈধ উপায়ে রপ্তানীর ব্যবস্থা হলে ইলিশ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
১১. চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী ও ধনাগোদা নদী দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা গেলে দেশীয় জাতের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। উন্নত যোগাযোগ এসব মাছ দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
১২. জেলার পুকুর, ডোবা, খালসহ বিভিন্ন জলাশয়ে চাষকৃত মাছের বাজারের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটবে এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। নদীতে খাচায় মাছ চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর সুযোগ রয়েছে।
১৩. এখানকার পাটশিল্পের পুনর্জাগরণ সম্ভব রপ্তানী বৃদ্ধি এবং পাটজাত আধুনিক গৃহস্থালী পণ্য উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে।
১৪. চাঁদপুরের নদ-নদীর মিঠাপানি প্রক্রিয়াজাত করে বিশুদ্ধ খাবার পানির বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব দেশে-বিদেশে। পৌরসভার মতো গ্রামে গ্রামে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যা সর্বাধিক আর্সেনিক আক্রান্তের হাত থেকে জেলাবাসীকে রক্ষা করতে পারে।
১৫. আরো ব্যাপক আশ্রায়ন প্রকল্প করে স্থানীয় ও অন্যান্য জেলার ভ‚মিহীন ও কর্মহীন মানুষের আশ্রয় ও কর্মের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখনো অনেক জেলার শ্রমজীবী শ্রমজীবী হিসেব এবং এখানে রিক্সা, অটোরিক্সা, সিএনজিসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
১৬. চাঁদপুরের দু’টি বৃহৎ সেচ প্রকল্পে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশের খাদ্যের যোগানে অবদান রাখতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন কৃষকদের প্রযুক্তি ও আর্থিক বিভিন্ন ধরনের সুবিধা ও প্রণোদনা দেওয়া। এছাড়া গম, পান, আখ, ডাল, সয়াবিন প্রভৃতি পণ্যের চাষ বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত কল-কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে।
১৭. সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সাংবাদিকতার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। বিশেষ কমিউনিটি রেডিও এবং বিটিভি ও বেতারের আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করলে জেলাবাসী উপকৃত হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার সহজ হবে স্থানীয় সাংবাদিক ও পত্রিকাগুলোর।
১৮. গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের মতো ঢাকা তথা কেন্দ্রের রাজনীতিতে চাঁদপুরের রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
১৯. চাঁদপুর প্রবাসীবহুল জেলা হওয়ায় প্রবাসীদের প্রশিক্ষণ, ঋণ, বৈধপথে টাকা আসা এবং স্থানীয় বিনিয়োগে উৎসাহিত করার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২০. উন্নত যোগাযোগ এখানকার শিক্ষাক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারবে। বর্তমানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি আরো অনেক বিশেষায়িত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা দরকার। এর সুবিধা পাবে চাঁদপুর ও আশপাশের কয়েকটি জেলা। ঢাকার উপর চাপ কমবে।
২১. এখানকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকাগামী রোগীর চাপ সামাল দেয়া যাবে। আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষও উপকৃত হবে। এখান কলেরা গবেষণার মতো আরো অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা দরকার।
২২. ধর্মপ্রবণ মানুষ হওয়ায় ধর্মের সঠিক প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে মাদক, ইভটিজিং, সন্ত্রাস, বাল্যবিয়ে ও অপরাধ দূরীকরণে ধর্মীয় নেতাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
২৩. নদীমাতৃক এই জেলায় মেরিন ও নৌবিদ্যার নানা প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। আবহাওয়ার আঞ্চলিক কেন্দ্র করা যেতে পারে।
২৪. বিদ্যুৎ কেন্দ্র নতুন আশার সঞ্চার করেছে। আরো বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে দেশের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। জ্বালানী ও খনিজ সম্পদের সার্ভে করা প্রয়োজন।
২৫. চাঁদপুরের নদীর বালি পরিকল্পনামাফিক উত্তোলন করলে সরকারের বিপুল রাজস্ব, নাব্যতা দূর এবং নদীর প্রবাহ সচল থাকবে। সারাদেশের বড় অংশের বালি এখান থেকে দেওয়া সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক সবচেয়ে বড় সম্পদ হতে পারে বালি। এই শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
২৬. চাঁদপুরের অর্থনৈতিক অঞ্চলে গার্মেন্টস ও চামরা শিল্প স্থাপনের উপযোগী বেশ। জনবল ও কাঁচামাল সহজলভ্য। এভাবে ঢাকার উপর চাপ কমবে। এখানকার হাজার হাজার গার্মেন্টস্ কর্মীকে ঢাকা থাকতে হবে না। নিজ নিজ বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারবে।
২৭. মৎস্য, নৌ-পরিবহন, পাট ও বস্ত্রসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের সদর দপ্তর চাঁদপুওে করা যেতে পারে।
২৮. আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলন, সভা, সেমিনারের জন্য ঢাকার বিকল্প ভেন্যু করা যেতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি আবাসন সুবিধা উন্নত করা প্রয়োজন। উন্নত দেশে এমন নজির আছে।
২৯. উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা যেতে পারে।
৩০. দেশী-বিদেশী, সরকারি-বেসরকারি একটি সমন্বিত প্রকল্প/উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগের মধ্য থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ/বর্জন/সংযোজন করে স্বল্প, মধ্য ও মেয়াদী মেয়াদী বাস্তবায়ন কৌশল ঠিক করতে হবে। আর উদ্যোগসমূহ সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, বরাদ্দ, প্রণোদনা ক্ষেত্রে ঠিক করতে হবে।
প্রয়োজনে বন্ধুরাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র এবং দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে চুক্তিভিত্তির ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মকান্ড করা যেতে পারে। যা দীর্ঘমেয়াদে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের টোল/ইজারা/সার্ভিস ফি থেকে আদায়যোগ্য হবে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত অনেক দেশ এভাবে দ্রুত উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়া এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
-লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ।