অনৈতিহাসিক : সর্বনাশা কোভিড মোহাম্মদ নাসিমের পর কামরান-আব্দুল্লাহকেও কেড়ে নিল

মুহম্মদ শফিকুর রহমান :
সর্বনাশা কোভিড ১৯ মোহাম্মদ নাসিম এরপর বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এবং শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর প্রাণ কেড়ে নিল।আগে নিল দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী প্রফেসর ডঃ মোঃ আনিসুজ্জামান এবং প্রখ্যাত নির্মাণ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রাণ। কি ভয়াবহ দেশের সব সেলিব্রিটি বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে নিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে জামাতের আলবদররা যেভাবে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ঠিক আজও সে ভাবে কেড়ে নিচ্ছে। তবে এবার বুদ্ধিজীবীর বাইরেও যাকে পাচ্ছে তাকেও আক্রমণ করছে হত্যা করছে। অশরীরী এই দানবকে যেমন দেখা যায়না কথা বলা যায়না স্পর্শ করা যায়না কেবলই তার অ্যাকশন অনুভব করা যায়। এটি অবশ্যই আল্লাহর গজবই হবে। এবং মানুষই তার কুকর্ম দিয়ে এই গজব ডেকে এনেছে বলে মনে করি:
• আমরা সিরাতুল মুসতাকিম ছেড়ে খারাপ পথ ধরেছি
• আমরা আল্লাহর নিয়ামত প্রকৃতি ধ্বংস করছি
• আমরা আল্লাহর নিয়ামত পানির ধারা বন্ধ করছি
• আমরা নদ নদী পাহাড় বনাঞ্চল ধ্বংস করছি
• আমরা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছি
• আমরা অবলীলায় মানুষ হত্যা করছি
• আমরা ব্যক্তি স্বার্থকে ধর্মীয় বিধানের উপরে স্থান দিচ্ছি
• আমরা ব্যাভিচার থেকে দূরে সরছিনা

তাই আজ তত্তবা-ইসতেগফার জরুরী এবং আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী চলব। অধর্ম থেকে দূরে থাকবো। তাহলে আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করবেন। কারণ তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া আমাদের যাবার আর কোন জায়গা নেই। তিনিই রাব্বুল আলামীন, তিনিই রাহমানুর রাহিম, তিনিই গাফুরুর রাহিম, তিনিই আলিমুল গায়েব, তিনিই খালেক, তিনি মালিক, আমরা তার সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত। আমরা ঠিকমত ক্ষমা চাইলে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করবেন এবং (কোভিড ১৯ বা করোনার ঔষধ আবিষ্কারের তৌফিক দান করবেন। করোনা তুলে নেবেন মাটি থেকে।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি বেছে বেছে মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে।গেল তিন চার দিনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নিজেও খুব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন।আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন সংসদের সাবেক চিফ হুইপ সিলেটের উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এবং বর্তমান সংসদের আরো কয়েকজন সদস্য সংক্রমিত হয়েছেন।

এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আমাদের কিছু করার নেই কেবল আল্লাহপাকের কাছে তাদের রোগমুক্তি কামনা করতে পারি, করছি। এরা সবাই ভালো মানুষ ছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই রাজনীতির ব্যানারে এরা মানুষের সেবা করেছেন। যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন তাদের কবরকে বেহেশতের দরজা বানিয়ে দেন যারা আক্রান্ত তাদের আশু রোগমুক্তির ব্যবস্থা করে দেন এবং মানবজাতির ওপর থেকে এই বালা তুলে নেন।

দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হচ্ছে ঐসব মান্য ব্যক্তিদের মৃত্যুতে নোংরা রাজনীতির চেহারা আরেকবার লক্ষ্য করা গেল। আইসোলেশনে আছি তাই সময় কাটানোর জন্য কয়েকদিন ট্যাবে ইউটিউব দেখেছি এতে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়:
১. ওয়াজ, বেশ কিছু চেনা মুখ যারা পবিত্র কোরআনে হাফেজ এবং তারপর কেউ আলিয়া হয়ে জেনারেল ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। আবার কেউ বা মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ প্রাপ্ত। এরা সত্যি সত্যি অনেক জানাশোনা মানুষ। বিশেষ করে কোরআন হাদিসের ওপর তাদের অনেক জ্ঞান। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে তাদের অনেকেই কি করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সমর্থন করতে পারেন। যে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর একাত্তরের ভূমিকার জন্য প্রকাশ্য আদালতে বিচার হয় সাজা হয়েছে আমৃত্যু কারাভোগ। এই সাঈদী জামাত-শিবিরের প্রভাবশালী নেতা। প্রথম দিকে তিনি জামাত করেননি। পরে জামাতে যোগদান করে দলের শীর্ষ পর্যায়ে কয়েকজনের কাতারে চলে আসেন। প্রশ্ন হচ্ছে এই জামাত কে এবং জামাত নেতারা কারা?

বাংলাদেশের একজন মানুষও পাওয়া যাবে না জামাত পন্থী ছাড়া যিনি জামাত-শিবিরের ১৯৭১ সালের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত নন। সেদিন তারা পাকিস্তানি মিলিটারি বর্বরতার সহযোগী হিসাবে গণহত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছে বিভিন্ন বাহিনী বানিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করেছে। নির্মমভাবে গুলি করে ব্যয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবচেয়ে বড় গ্রিনার কাজ করেছে ৫ লক্ষাধিক বাঙালি নারীর ইজ্জত লুন্ঠন করেছে।

সেই জামায়াত তথা পাকিস্তানি বর্বরদের যারা সমর্থন করেন বা যারা সেই জামাতের রাজনীতি এগিয়ে নেবার জন্য তাদের সাথে যোগ দেন এবং কাজ করেন তিনি আর যাই হোন মানুষ পদবাচ্য হবেননা এটি বলা যায়। অতএব সাঈদীর জন্য যারা ইউটিউবে গলা পাটান তারা কারা? চিনতে কি খুব অসুবিধা হয়?

২. এই ইউটিউবে কিছু ধর্মীয় চ্যানেলে দুই-তিনজন আছেন যাদের কেউ ইসলামী লেবাসে আসেন আবার কেউ ক্লিন শেভড।এদের কাজ হচ্ছে কেবল বর্তমান সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যা-তা বলা। বানিয়ে বানিয়ে এমন সব কথা প্রচার করে যা শুনলে ঘৃণা হয়।

মোহাম্মদ নাসিম চলে গেছেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন এই দোয়া করি। অথচ ইউটিউবের ঐ মুল্লা চেহারা ও ক্লিন চেহারার ঐ কয়েকটি লোক নানান আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। ঘৃণা হয় না কি?

৩. মুভি। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় বা মুম্বাইয়ের মারদাঙ্গা ছবি। নায়ক একাই ডজন-ডজন গুন্ডাকে পিটিয়ে সোজা করে দিচ্ছে।দেখতে ভালই লাগে এজন্য যে আমরা আমাদের সমাজের গুন্ডাপান্ডা সন্ত্রাসী লুটেরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মত আন্ডারগ্রাউন্ড টেরোরিস্টের নির্মূল করতে চাই কিন্তু পারি না তাই সিনেমায় যখন ওরা করে তখন আমাদেরও ভালো লাগে।

যাকগে মূল কথায় ফিরে আসি।ছাত্রলীগের পরিচয় নিয়ে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিএ অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই। থাকার জায়গা পাই দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল।ঐ বছরই হলটি উদ্বোধন করা হয় এবং আমরা প্রথম ব্যাচের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। তখন ক্যাম্পাসে মানে উত্তাল পরিবেশ।বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবির পক্ষে এবং তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে দিন রাত সারাক্ষন মিছিল মিটিং চলছে।

চাঁদপুর কলেজে এইচএসসির ছাত্র থাকাকালে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম এবং ঢাকায় এসে কর্মী হতে সময় লাগলোনা। ছাত্র রাজনীতির সুবাদে যেমন বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মুজাফ্ফর অহিদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, মমতাজ বেগম, এবং তাদের সমসাময়িক আন্ডারগ্রাউন্ড ওভার গ্রাউন্ড দেশবরেন্য নেতাদের নাম ও পরিচয় যেমন জেনেছি তেমনি ছাত্র রাজনীতির শেখ ফজলুল হক মনি, আমির হোসেন আমু, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মোহাম্মদ ফরহাদ, সাইফুদ্দিন, মানিক প্রমুখদের নামও তেমনি জেনেই ঢাকায় প্রবেশ করেছি।

মোহাম্মদ নাসিমকে চিনেছি আরো অনেক পর। নাসিম ভাইকে চিনেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার বেশ পর। বিশেষ করে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ দুই বছর করে দুই টার্ম জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং প্রায়ই মাননীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে প্রেসক্লাবে আসতেন। কেননা আন্দোলন মূলত আবর্তিত হত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ নূর হোসেন চত্বর পল্টন মোড় দৈনিক বাংলার মোড় এবং মতিঝিল অঞ্চল নিয়ে। নেত্রী সেদিন পার্লামেন্টে মোহাম্মদ নাসিমের ওপর শোক প্রস্তাবের আলোচনায় রীতিমত কেঁদে ফেলেছেন।

আমি এমনিতেই ভীষন ভদ্র সাংবাদিক ও কর্মীবান্ধব মিষ্টিভাষী রসিকতা করতেন না হেসে এই মানুষটির রাজনৈতিক জ্ঞান এত প্রখর ছিল যে তিনি তার দল দলীয় রাজনীতি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখতেন। এত সুন্দর ভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন একজন আনকোরা রিপোর্টারেরও বুঝতে অসুবিধা হতোনা। রাজনীতি করেছেন একদম ছাত্রজীবন থেকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির কারণে কলেজ থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন।

তারপর ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে নাইটে ভর্তি হয় পড়ালেখা শেষ করেন। মন মানসিকতা পুরোটাই ছিল রাজনৈতিক। হয়তো পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে পেয়েছেন। বাবা এম মনসুর আলী ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন এবং প্রয়াত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সাথেই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আর ৩ ঘনিষ্ঠজনের সাথে ঘাতক বুলেটে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করার পর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দিন আহমেদ এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কয়েকদিন পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। সেই সব হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা গ্রীক ট্রাজেডীকেও হার মানায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক মিলিটারি জিয়া ক্ষমতা দখল করে বঙ্গভবনে বসে ছিল।

মোশতাক জাতীয় চার নেতাকে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আহ্বান জানালে মুনসুর আলী মুশতাককে জাতির পিতার খুনি আখ্যায়িত করে বলেছিলেন তোমার হাতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের রক্ত তুমি কি করে আশা করো আমরাও বঙ্গবন্ধু রক্তের সাথে বেঈমানি করব। কারারন্তরান অপর তিন নেতাও একইভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মোশতাক তার শোধ নেন তাদের হত্যা করে। এই বলে গ্রিনাভরে মুশতাকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তখন খুনি মোশতাক জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা চাট্রিখানি কথা ছিলনা।

এ জন্য বুকের পাঠা থাকা দরকার।হবেনাইবা কেন ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতা ঘোষণা দেবার পরই পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং কারাবন্দী করে। তার অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন উল্লেখিত জাতীয় চার শহীদ নেতা। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের আগেই সবকিছু জাতীয় চার নেতাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

সেই চার নেতার অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলীর পুত্র মোহাম্মদ নাসিম। এমন বাপের সন্তান বলেই মোহাম্মদ নাসিম স্বৈরাচারী এরশাদ খালেদা জিয়া ও মুইনউদ্দিন ফখরুদ্দিনের সরকার ও তাদের পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ প্রেমিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এর জন্য তার রক্তও ঝরেছে বারবার :

• ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ মিলিটারি এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। কালো ছায়া নেমে আসে গোটা বাংলাদেশে। তারপরও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে। পরের বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এবং ২৬ মার্চ সূর্য ওঠার আগেই নেতৃবৃন্দ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষপস্তবক অর্পনের জন্যে মেইন গেট থেকে সৌধের বেদীর দিকে এগোতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।

এই সময় মোহাম্মদ নাসিম সৈয়দ সাজেদা চৌধুরী বেগম মতিয়া চৌধুরী তোফায়েল আহমেদ একযোগে স্লোগান দিতে শুরু করেন:
: সামরিক শাসন মানিনা মানবোনা
: মার্শাল ল তুলে নাও নিতে হবে
• সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ উল্লেখিত নেতাকে ঘিরে ফেলে। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাক করেসপেন্ডেন্ট এবং আবু মুসা হাসান দৈনিক সংবাদে (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) পাশেই দাঁড়ানো ছিলাম।এসময় এসবির অফিসার শাহ আলম আমাদের কাছে এসে মৃদুস্বরে বললেন আমার সঙ্গে আসুন এখানে থাকা যাবেনা। ততক্ষনে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরাও সরে পড়েছেন।

শাহ আলম আমাদের সাথে নিয়ে গেটে ডান পাশে ফুটপাতের ওপর দাঁড়ালো। এ সময় ১২/১৩ জনের একদল তরুণ হাতে রাবার রড বৈদ্যুতিক তার মুড়িয়ে বানানো রড হাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। একজন আমাদের কাছে এসে ইংরেজিতে বললেন “Who are you bastard?” শাহ আলম সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন আমি এসবির অফিসার উনারা দুজনে সংবাদিক। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। তরুণ রড ওয়ালা চলে গেলেন।নইলে ঐ রডের একবাড়ি খেলে দ্বিতীয়টির আর দরকার পড়তোনা। Thanks to almighty the saving আমাদের রক্ষা করলেন।

১. কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম রড হতে তরুণরা ঐ চার নেতাকে নিয়ে সাভার ক্যান্টনমেন্ট-এর দিকে চলে যায়।যাবার পথে হাতের রড দিয়ে চার নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মোহাম্মদ নাসিম তোফায়েল আহমেদ ও বেগম মতিয়া চৌধুরীকে অমানসিকভাবে পেটালেন। পেটাতে পেটাতে ক্যান্টনমেন্টের দিকে নিয়ে গেলেন। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

২. সন তারিখ মনে নেই। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে নির্যাতন বিরোধী মিছিল বের হবার কথা। তখন খালেদা জিয়ার দূঃশাসন।নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল। সামনে মোহাম্মদ নাসিম ও বেগম মতিয়া চৌধুরী।মিছিল রাসেল স্কয়ারে এলে পুলিশ বাধা দেয় এবং মোহাম্মদ নাসিম কারণ জানতে চেয়ে তাদের সাথে তর্কে অবতীর্ণ হন এই পর্যায়ে পুলিশ বেধড়ক পিটুনি শুরু করে নেতাকর্মী কোন বাছবিচার নেই। পুলিশের বাড়িতে মোহাম্মদ নাসিম ও মতিয়া চৌধুরী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নির্দয় নিষ্ঠুর পুলিশ মাটিতে ফেলেও তাদের ভীষণভাবে পেটায়।

৩. আরেকবার ৩২ নম্বরের পাশে মিরপুর সড়কে পুলিশ তাদের মিছিলে আক্রমণ করে এবং এখানেও একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ মোহাম্মদ নাসিমকে অমানুষের মত মাটিতে ফেলে পেটায়। সেদিনও অনেকেই চোখের পানি রাখতে পারেনি।

গত ১৪ জুন মোহাম্মদ নাসিম ও শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ওপর শোকপ্রস্তাব আলোচনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আবেগাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে কেঁদে দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন পিতার মতোই বিশ্বস্ত। যে কারণে নেত্রী যখনই সুযোগ পেয়েছেন তাকে দলে এবং সরকারে কাজে লাগিয়েছেন। স্বাধীনতার পক্ষের মহাজোট বা ১৪ দলীয় জোট গঠন করে তাকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ নাসিম অসুস্থ শরীর নিয়েও ১৪ দলের অন্যান্য শরিকদের নিয়ে সরকারেরই পারপাস সার্ভ করেছেন। অর্থাৎ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল তার কাছে প্রিয়।

সর্বশেষ যে কথাটি বলতে চাই তাহলো বস্তুত মোহাম্মদ নাসিমকে হত্যা করা হয়েছে। মিলিটারি এরশাদ, হাফ মিলিটারি খালেদা জিয়া মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সর্ব আমলেই অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সাথে নির্যাতন চালানো হয়। মোহাম্মদ নাসিমকে অধকাবস্থায়ও নির্যাতন চলালো তখন তার ব্রেইন স্ট্রোক হয় এবং শরীরের বাম অংশ অবস ও অকেজো হয়ে যায়।

এর মধ্যেও তিনি একদিনের জন্যও তার এলাকা সিরাজগঞ্জের কাজিপুর-এর মানুষসহ বাংলাদেশের জনগণের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন এবং মাননীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পাশে থেকে তাকে সাহায্য করেছেন শক্তি যুগিয়েছেন।এবারো মৃত্যুর আগে হাসপাতালে নেওয়া হলে পুনরায় ব্রেইন স্ট্রোক হয় এবং তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহ..)। তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন ব্রেন স্ট্রোক এর জন্য যারা দায়ী তারা কি মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়?

• চলে গেলেন সিলেটের বদরুদ্দিন আহমদ কামরান।অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা এবং সিলেটের জনগণের অভিভাবক। তিনিও মোহাম্মদ নাসিমের মত নেত্রীর বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি দুইবারের সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। এর আগে কাউন্সিলরও ছিলেন। অর্থাৎ একেবারে তৃণমূল থেকে রাজনীতির আকাশে নক্ষত্রের মতো উঠে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে মাননীয় নেত্রী যেহেতু সব কমষ্টিটিউয়েঙ্গীতে সভা করতে পারবেন না সেহেতু দলীয় মেয়রদের ভাগ করে সারাদেশে দায়িত্ব দেন।আমার এলাকা ২৬৩ চাদপুর-০৪ ফরিদগঞ্জে দায়িত্ব পড়ে সিলেটের মেয়র বদরুদ্দিন আহমদ কামরানের। এ উপলক্ষে আমি একটি জনসভার আয়োজন করি ধানুয়া বাজার স্কুল মাঠে।কিন্তু চাঁদপুর জেলার তথাকথিত আওয়ামীলীগ নেতা শামসুল হক তাকে জনসভায় না আসতে টেলিফোনে অনুরোধ জানান। প্রকারান্তরে গন্ডগোলের ভয় দেখান।

কিন্তু কামরান তা আমলে নেননি। এটাই তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতাদের গুন। তিনি এসেছিলেন এবং দুর্দান্ত একটি বক্তৃতা দেন।এর আগেও চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ এ অঞ্চলে সফর করেন চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ-রায়পুর-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী হয়ে চট্টগ্রাম ফিরে যান। শামসুল হক ওইদিনও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের দিয়ে আমাকে মঞ্চে উঠতে দিচ্ছিলনা।

গৃদকালিন্দিয়া আইয়ুব আলী খাঁ বিদ্যালয়ের মাঠে সভামঞ্চে আমাকে ও রায়পুরের হারুন-অর-রশীদকে মঞ্চে তার পাশেও যেতে দিচ্ছিলনা দেখে মেয়র মহিউদ্দিন শামসুল হককে ধাক্কা মেরে পেছনে হাটিয়ে আমাকে ও হারুন সাহেবকে তার দুই পাশে দাঁড় করান। আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল ফরিদগঞ্জ সদরে পাশে ডাকাতিয়া নদীর ওপর একটি বেইলি ব্রিজ ছিল পুরনো হয়ে যাওয়ায় গাড়িতে জাকিং হচ্ছিল।

আমি জনগণের পক্ষে একটি দরখাস্ত লিখে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি মহসিন হলে থাকতাম। পরষ্পর পরষ্পরকে জানতাম। তিনি কর্মকর্তাদের ডেকে আমার দরখাস্ত লিখে দেন “I want this project to be done within this financial year”. ব্রিজটি নির্মিত হয় পাকা ব্রিজ।এমনি ১০ টি প্রকল্প উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদপুর থেকে। নির্ধারিত দিনে নেত্রী চাঁদপুর এলেন।

আমি পাঁচ থেকে ছয় হাজার লোকের মিছিল নিয়ে জনসভায় উপস্থিত হয় এবং নিজেই কর্মীদের পাশে বসি। নেত্রী মঞ্চে থেকে মার্ক করেন এবং তার তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারি আজাদ ও এপিএস শেখরকে পাঠান আমাকে মঞ্চে নিয়ে যেতে। আমি মঞ্চে গেলে সামনের দিকে কোন জায়গা ছিলনা।নেত্রী শামসুল হককে পেছনে পাঠিয়ে আমাকে সামনের সারিতে বসান কুমিল্লার বাহার ভাইয়ের পাশে। চাঁদপুরবাসী কৌতুহলভরে এই দৃশ্য উপভোগ করে। তারপরও আক্কেল হয়না।

• কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাস আরেকজন প্রিয় মানুষকেও নিয়ে গেল। তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ টুঙ্গিপাড়ায় নেত্রীর সংসদীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। সর্বশেষ তাকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে নেত্রীর পক্ষে কওমি মাদ্রাসার নেতাদের সাথে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় উপনীত হন। আজ তাদের কাছে আওয়ামীলীগ যেমন বৈরি নয় তেমনি তারাও আওয়ামী লীগের বৈরি নয়।

মনে পড়ে ৮০-র দশকের কথা।শেখ হাসিনা দীর্ঘ ছয় বছরের প্রবাস জীবন থেকে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফেরেন। তখন থেকে তিনি টুঙ্গিপাড়া যাওয়া শুরু করেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আমার চেয়ে বেশি বার তার সাথে অন্তত সাংবাদিকদের কেউ সফর করেনি। তখন টুংগীপাড়া যাতায়াত ছিল কষ্টকর। লঞ্চ ইঞ্জিনচালিত নৌকা রিক্সা এইভাবে যেতে হতো।

আমরা যখনই যেতাম এই মানুষটি শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহকে দেখেছি সারাক্ষণ তৎপর থাকতেন। টুঙ্গিপাড়ায় থাকার মত কোন হোটেল বা ডাকবাংলা ছিলনা। প্রথম প্রথম টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির নিচতলার দক্ষিণাংশ ড্রইংরুমে আমরা রাত্রি কাটাতাম। এক পর্যায়ে শেখ আব্দুল্লাহ আমাদের তার গোপালগঞ্জ শহরের বাড়িতে নিয়ে যেতেন এবং সব রকম দেখাশোনা করতেন। এই মানুষটিও চলে গেলেন নেত্রীর পাশে থেকে।

জানিনা করোনার ছোবল কোথায় গিয়ে কতদিন পর্যন্ত ঘায়েল করবে। এরই মধ্যে হাজারের ওপর মানুষ ইন্তেকাল করেছেন। তাদের সবাই সমাজ ও রাষ্ট্রের মান্যি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। শুরুতে আমি বলেছি এ আপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব হতে পারে এবং আমরা লোভী মানব জাতি এ আপদ ডেকে এনেছি। এবং আল্লাহই কেবল একে আমাদের ওপর থেকে তুলে নিতে পারেন। অতএব আসুন সবাই মিলে তওবা করি ক্ষমা চাই।আল্লাহ গাফুরুর রাহিম নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করবেন।

ঢাকা- ১৮ জুন ২০২০
লেখক- এমপি
সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
ই-মেইল- balisshafiq@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন