চাঁদপুরে করোনা শনাক্তের এক বছর : দিনে গড়ে আক্রান্ত ১০, সপ্তাহে মৃত্যু ২

রহিম বাদশা :
চাঁদপুরে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্তের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল শুক্রবার। গতবছরের ৯ এপ্রিল চাঁদপুরে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে জেলায় ২১ হাজার ৮৭৮জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০জন (৫৯.৬৯) নমুনা দিয়েছেন। মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ৩৫৩৫জন। সে হিসেবে, প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০জন (৯.৬৫)। এক বছরে মারা গেছেন ৯৮জন। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় ২জন (১.৮৮) করে মারা গেছে।

সরকারি এই পরিসংখ্যান মূলত চাঁদপুর জেলায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত রিপোর্টের আলোকে প্রস্তুতকৃত। এছাড়া জেলায় আরো অনেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাসা-বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন, নিচ্ছেন। যাদের অনেকে মারাও গেছেন। প্রথম দিকে উপসর্গে কেউ মারা যাওয়ার খবর পেলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা মৃতের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করতো। এমন পদ্ধতিতেও কিছু মৃত্যু করোনাজনিত বলে জানা গেছে। কিন্তু বেশুমার মৃতের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি বা হয়নি নানা কারণে। আর এখন স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনায় মৃতদের নমুনা সংগ্রহ করাই হচ্ছে না। ফলে কার্যত আক্রান্ত ও মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তথ্য অজানাই থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে গতবছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও চাঁদপুরে সন্দেহভাজন লোকদের নুমনা সংগ্রহ শুরু হয় ২৭ মার্চ। ওইদিন ঢাকার আইইডিসিআর থেকে বিশেষ টিম এসে চাঁদপুরের একজনের নমুনা সংগ্রহ করে। ২ এপ্রিল চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিসের তত্ত¡াবধানে চাঁদপুর জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। প্রথম দিনে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ থেকে ২জন করে মোট ১০জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। চাঁদপুর প্রবাহের আর্কাইভ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

উল্লেখিত সূত্রে আরো জানা যায়, চাঁদপুরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৯ এপ্রিল। তার নাম মোঃ সুজন (৩২)। নারায়ণগঞ্জ ফেরত এই যুবক অসুস্থ অবস্থায় মতলব উত্তরে তার শ্বশুর বাড়িতে আসার পর ৬ এপ্রিল নমুুনা দিয়েছিলেন। চিকিৎসার পর তিনি এখন সুস্থ।

প্রথম শনাক্তকৃত করোনা রোগী সুজনের নমুনা টেস্টের পজেটিভ রিপোর্ট আসার দিনেই (৯ এপ্রিল) চাঁদপুর জেলা লকডাউন ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক। ওইদিন সন্ধ্যায় এই লকডাউন কার্যকর শুরু হয়। টানা কয়েক মাস চলে সেই লকডাউন। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় মাঝখানে কয়েক মাস কার্যত লকডাউন ছিল না। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদপুরে কখনোই লকডাউন প্রত্যাহার ঘোষণা করা হয়নি। এখন সরকারি নির্দেশনায় আবারো সারাদেশে সপ্তাহব্যাপী লকডাউন চলছে।

চাঁদপুরে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১১ এপ্রিল চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা এলাকায়। তিনিও নারায়ণগঞ্জ ফেরত। শ্বশুর বাড়িতে করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে। ১৫ এপ্রিল তার নমুনা টেস্টের রিপোর্ট আসে করোনা পজেটিভ। এরপর তার শ্বশুর ও এক শ্যালিকা করোনায় আক্রান্ত হন। শ্যালিকা সুস্থ হয়েছেন। আর শ্বশুর করোনা থেকে সুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মারা যান।

চাঁদপুরে করোনার আগমন ও সংক্রমণের বাহক হিসেবে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরত লোকদের চিহ্নিত করেছে। প্রথম পর্যায়ে বিদেশ ফেরত লোকদের সন্দেহের শীর্ষে রাখা হলেও জেলায় বিদেশ ফেরত লোকদের মধ্যে করোনা তেমন সংক্রমণ দেখা যায়নি। চিকিৎসকদের মতে, গত কয়েক মাস ধরেই সারা জেলায় করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন চলছে। তবে গত দু’সপ্তাহ ধরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে।

সিভিল সার্জন অফিসের হিসেবে, গত দুই সপ্তাহেই (২৭ মার্চ-৯ এপ্রিল) জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮২জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৪জনের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এই সময়ে মারা গেছেন ৮জন। এই তথ্য আশঙ্কাজনক। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে করোনার উপসর্গে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে চাঁদপুরে।
সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল­াহ ৯ এপ্রিল চাঁদপুর প্রবাহকে জানান, গত এক বছরে চাঁদপুর জেলায় করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৩৫২৫জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৮জন। সুস্থ হয়েছেন ২৯১৬জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৫১১জন। এত অধিক সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা ও সেবা নিতে স্বাস্থ্য বিভাগ হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে সদর হাসপাতালের করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে এখন বেডের চেয়ে রোগী বেশি।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর জেলায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ৩৫২৫জনের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ১৬১৭জন, ফরিদগঞ্জে ৩৭৩জন, মতলব দক্ষিণে ৩৪৩জন, হাজীগঞ্জে ৩২২জন, শাহরাস্তিতে ২৯৮জন, মতলব উত্তরে ২৫৫জন, হাইমচরে ১৯৪জন ও কচুয়ায় ১২৩জন।

সূত্র আরো জানায়, করোনায় জেলায় মোট ৯৮জন মৃতের উপজেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান হলো : চাঁদপুর সদরে ৩৩জন, হাজীগঞ্জে ১৭জন, ফরিদগঞ্জে ১৫জন, মতলব উত্তরের ১১জন, শাহরাস্তিতে ৯জন, কচুয়ায় ৬জন, মতলব দক্ষিণে ৫জন ও হাইমচরে ২জন।

উল্লেখিত পরিসংখ্যানের বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং বিদেশে চাঁদপুরের বহু লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন অনেকে। বিক্ষিপ্তভাবে তাদের অনেকের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও সঠিক পরিসংখ্যান এখনো সরকারি-বেসরকারি কোনো সূত্র জানাতে পারেনি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)