বঙ্গবন্ধুর আদুরে ছোট কন্যার জন্মদিন আজ


দুলাল আচার্য :

জন্মদিনে প্রতিবার একটি ফুল দিয়ে
শুভেচ্ছা জানানো ছিল
আমার সবচেয়ে আনন্দ।
আর কখনো পাবো না এই সুখ
আর কখনো বলতে পারবো না
শুভ জন্মদিন।
কেন এমন হল?
কে দেবে আমার প্রশ্নের উত্তর।
কোথায় পাবো তোমায়…

যদি সন্ধ্যাতারাদের মাঝে থাকো
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলবো
শুভ জন্মদিন।
তুমি কি মিটি মিটি জ্বলবে?

যদি বিশাল সমুদ্রের সামনে
ঢেউদের খেলার মাঝে থাকো বলবো
শুভ জন্মদিন।

সমুদ্রের গর্জনে শুনবো কি
তোমার বজ্রকণ্ঠ?
পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে মেঘ
নীল আকাশে লুকোচুরি খেলে
তুমি কি ওখানে?
তাকিয়ে বলবো
শুভ জন্মদিন।

এক টুকরো সাদা মেঘ ভেসে যাবে
ওখানে কি তুমি?
আকাশে বাতাসে পাহাড়ে উপত্যকায়
তোমাকে খুঁজবো, ডাকবো
যে প্রতিধ্বনি হবে
ওখানে কি তুমি?
শুভ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন।
২০১০ সালে ’বাবা’ শিরোনামের এই কবিতাটি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা; বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে না পারার আক্ষেপ ঝরেছিল কবিতায়। বাবার স্মৃতি তার কাছে অমলিন। ¯েœহ-মায়া-মমতা-আন্তরিকতা-বন্ধুত্ব সবই পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। বাবা আর মায়ের অপরিসীম ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা জীবনে তাদের হারিয়ে অমানিশার অন্ধকারই দেখেছেন। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এখনও তিনি খুঁজে ফেরেন বাবাকে। শোকের পাহাড় ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে যেতে ফিরেছেন সময়ের বাস্তবতায়। বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারায় নিজেকে রেখেছেন সম্পৃক্ত।

আজ ১৩ সেপ্টেম্বর রোববার বঙ্গবন্ধুর সেই আদুরে ছোট কন্যা শেখ রেহানার জন্মদিন। ১৯৫৫ সালের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ তিনি ৬৫ বছরে পা রাখছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। আমাদের ‘ছোটআপা’। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনও সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি তিনি। নীরবে নিবৃত্তে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, সংগ্রাম করে যাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে। অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় রাজনীতিবিদদের। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে (সংস্কারের নামে) যে বিভক্তিকরণ দেখা দিয়েছিল তা রুখতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন শেখ রেহানা। সে সময়ে পর্দার আড়ালে থেকে দলের ঐক্য বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। বিশ্লেষকদের ধারণা, শেখ রেহানা সেসময় দলকে যদি আগলে না রাখতেন তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস হয়তো অতীতের মতো অগণতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। সে সময় শেখ হাসিনার স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানির কার্লসরুইয়ে বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকায় বেঁচে যান শেখ রেহানা। সেখান থেকে ভারতে চলে যান দুই বোন। শেখ রেহানা পরে পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। শেখ রেহানা বিয়ে করেন ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিককে। লন্ডনের কিলবার্নে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথী, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে। শফিক সিদ্দিক তখন বিলেতের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষারত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় থাকাকালীন তিনি সেখানে এসেছিলেন। শেখ রেহানাও বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হবার পর বড়বোন শেখ হাসিনার সাথে জার্মান থেকে দিল্লি চলে যান এবং সেখান থেকে পরে তাদের খোকা চাচার কাছে লন্ডনে চলে আসেন। এই প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণে শেখ রেহেনা বলেন, ‘এমন পর্যায়ে যখন অনুভব করছিলাম আমার মাথার উপরে একটি ছায়া দরকার, ঠিক তখনই বিয়ের আলাপ আসে। ড. শফিক সিদ্দিক তখন পড়াশোনার জন্য লন্ডনে। এ প্রস্তাব অবশ্য আব্বা বেঁচে থাকতেই নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। কিন্তু আব্বা বলেছেন, পড়ালেখা শেষ হোক এরপর দেখা যাবে। একই প্রস্তাব যখন আবার এলো তখন বোন শেখ হাসিনা তার মতামতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু নিজের মাথার উপরে একটি ছায়ার আশায় বিয়ের প্রস্তাবটিতে সম্মতি দেন তিনি।’

বিয়ের পরও দুঃখ-কষ্ট শেখ রেহানা ও তার পরিবারকে তাড়া করে ফিরেছে। এ সময় নতুন করে নানামুখী সংকট মোকাবেলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে তাকে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। এই প্রসঙ্গে শেখ রেহেনা এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, ‘লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এর পর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে একজন শিপিং কর্পোরেশনের বড় অফিসার এ জেড আহমেদ আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন। আব্বার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুস ও মঈনুল ইসলাম সাহেবও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন মঈনুল ইসলাম সাহেব। ড. শহীদুল্লার নাতি মনসুরুল হক, তাকে আমরা হীরু মামা বলে ডাকি- তিনিও আমার জন্য অনেক করেছেন।’

বিয়ের পরপরই তিনি স্বামীর সাথে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সাথে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে, চাইলেও একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের ছিল না। সাদাসিধে ছোট একটি আড়ম্বরহীন ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন; বাসে, টিউবে-রেলেই চলাফেরা করতেন। অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন ছেলেমেয়ে। তাদের বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি। ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক।
মানবিক হৃদয়ের অধিকারী শেখ রেহানা। এই মানবিকতাই তাঁকে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত করেছে। আমার কর্মময় জীবনেও তার এই মানবিকতা ছায়া ফেলেছে। সেই মানবিকতার অংশ আজ তুলে ধরছি। নতুন ব্যবস্থাপনায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রকাশ হয় ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর। শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত এই ম্যাগাজিনটিতে সহ-সম্পাদক হিসেবে আমার কাজ করার সুযোগ হয় প্রথমদিন থেকেই। যদিও রেহানা আপা অফিসে খুব একটা আসতেন না। তবে খোঁজ-খবর রাখতেন নিয়মিত। তার হয়ে দায়িত্বপালন করতে বেবী আপা। সম্পাদক হিসেবে তার সাথে আমাদের বেশ কয়েকবার সরাসরি দেখা ও কথা হয়েছে। লন্ডন থেকে ফোন করে বেবী আপাকে না পেলে আমাদের সাথে কথা বলতেন রেহানা আপা। সেই সূত্রে যতটুকু জানি এবং দেখেছি একজন মানবিক বড় বোনের ছায়া। কথার মাঝেই আমাদের আপন করে নিতেন। সেই সূত্রে আমরা সবাই তাকে ছোট আপা বলে সম্বোধন করতাম। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

২০১২ সালের কথা। আমি তখন জনকন্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সম্ভবত সেটা এপ্রিল মাস। একদিন বিকালে রেহানা আপার ফোন। বললেন, দুলাল বলছো? আমি বললাম জ্বি। তিনি বললেন, আমি রেহানা আপা বলছি। আমি কথার ধরনে বুঝলাম আমাদের ছোট আপা। বললেন, কাল ১২ দিকে গণভবনে এসো। তোমার জন্য পাশ দেয়া থাকবে। গেইটে এসে বললেই হবে। আমি জ্বি আপা বলার পর ফোনটি কেটে যায়। পরদিন যথাসময়ে গণভবনে পৌঁছলাম এবং খুব অল্প সময়ে আনুষ্ঠানিকতা সেরে একটি রুমে বসলাম। কয়েক মিনিট পর আপা আসলেন। বললেন কেমন আছো? তারপর নানা বিষয়ে কথা। আমার বাবা তখন খুব অসুস্থ তিনি সেটাও জানতে পারলেন। বললেন শাকিলকে (মাহবুবুল হক শাকিল) বলেছি তোমার কথা। জনকন্ঠে কাজের পর তার সঙ্গে সিআরআইতে কাজ করবে। তোমার সমস্যা শাকিল দেখবে। আসার সময় আমার স্ত্রীর জন্য চারটি শাড়ি এবং একটি খাম দিয়ে বললেন, বাবার চিকিৎসা করাবে। আর শাকিলের সঙ্গে কালই দেখা করো। ভালো থেকো। পরে শুনেছি, আমার কথা রানা (সিআরআইতে আগে কাজ করতো, সেসময় গণভবনে কাজ করে) রেহানা আপাকে বলেছে এবং আমার নাম্বারও দিয়েছে। রেহানা আপার এই মানবিক সহযোগিতার জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

জনহিতৈষী কাজে বড়বোন শেখ হাসিনার পাশে সব সময়ই ভূমিকা রাখছেন শেখ রেহানা। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ রেহানা। শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণা আর শেখ রেহানার ভূমিকা আরও সুস্পষ্ট। বোন শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব নেতৃত্বের অংশীদার, তার পিছনে অন্যতম উৎসাহ শেখ রেহানার। ভক্তদের মূল্যায়ন, শেখ রেহানার ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শান্তির আলোকবর্তিকা হাতে আজ বিশ্বময় শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় মানুষের কল্যাণে তাঁর দুইকন্যার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাক। শুভ জন্মদিন আমাদের ছোট আপা। দীর্ঘায়ু হোন।

-লেখক : সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

০১৭১৬৫১৯৫৪১ (বার্তা বিভাগ)